একদিন বাবার জন্য ঘর বানাব, যদি পারি একটা এসিও লাগাব
আজ বাবা দিবস। এ উপলক্ষে বাবাকে নিয়ে লিখেছেন প্রথম আলোর পাঠকেরা। পড়ুন গাজীপুর ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির মো. ফখরুল হাসানের লেখা।
বাবাকে নিয়ে আমার ছোটবেলার কোনো স্মৃতি নেই। জন্মের মাত্র এক মাস পরেই তিনি বিদেশে চলে যান। যখন হাঁটতে শিখছি, কথা বলতে শিখছি, তখন ‘বাবা’ বলতে কিছুই বুঝতাম না। আমার শিশুমনে বাবা ছিলেন শুধুই গল্পের চরিত্র, যাঁকে সবাই শুধু নামেই চেনেন, কিন্তু আমি ছুঁয়ে দেখতে পারি না।
জীবনে বাবার প্রত্যাবর্তন ঘটে সাত বছর বয়সে। দেশে ফিরে তিনি ঢাকায় একটা চাকরি নেন। গ্রামে পড়ালেখা হবে না ভেবে আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেই থেকে শুরু আমাদের একসঙ্গে পথচলা। এখন আমার বয়স ২৪। এতটা সময় পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু জীবনের প্রতিটা বাঁকে, প্রতিটা কঠিন সময়ে বাবা পাশে ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর এই প্রথম তাঁর কাছ থেকে দূরে থাকা। এই দূরত্বই যেন প্রতিটা মুহূর্তে আমাকে বুঝিয়ে দেয়, যাঁকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি, যাঁর জন্য সবচেয়ে বেশি অগোচরে কেঁদেছি, তিনি আমার বাবা।
চেহারায়, গায়ের রঙে, আচরণে—আমাদের মধ্যে বাহ্যিক কোনো মিল নেই। কেউ দেখলে বলবে না আমরা বাবা-ছেলে। কিন্তু মনের গভীরে এক অদৃশ্য যোগসূত্র যে কত দৃঢ় হতে পারে, তা বোঝার জন্য কোনো রক্তের নমুনা লাগে না। বাবা সব সময় চেয়েছেন আমি যেন স্বাবলম্বী হই, বাস্তবতা বুঝে জীবন গড়তে শিখি। হাতে গুনে টাকা দিতেন, যেন বুঝেশুনে খরচ করি। কিন্তু পড়াশোনা বা প্রয়োজনীয় কিছুতে কখনোই কার্পণ্য করেননি, দরকার হলে ধার করে হলেও প্রয়োজন মিটিয়েছেন।
আমার বড় শখ বা আবদার কখনো ছিল না। শুধু একটাই স্বপ্ন ছিল, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে একদিন মা–বাবার শখ পূরণ করব। বাবার একটা গোপন শখ আছে, গাড়ি। আমি সব সময় ভাবি, কবে এমন সামর্থ্য হবে, কবে বাবার জন্য একটা গাড়ি কিনে দিতে পারব! সেই দিনের কল্পনায় বেঁচে থাকি।
একবার টিউশনি করে ঈদে বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনেছিলাম। ঈদের দিন তিনি যখন সেটা পরলেন, মনে হয়েছিল, এই ছোট্ট উপহারই বুঝি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। বাবা সন্তুষ্ট হলে সন্তানের মনে যে শান্তি জন্মায়, তা কোনো শব্দে প্রকাশ করা যায় না। ভাবি, একদিন নিজের সামর্থ্য হলে বাবার জন্য একটি ঘর বানাব, যেখানে উত্তর-দক্ষিণের হাওয়া অবাধে আসবে। যদি পারি, একটা এসিও লাগাব। আর সেই কাঙ্ক্ষিত গাড়িটা, যার চাবি একদিন বাবার হাতে তুলে দিয়ে বলব, ‘আব্বা, গাড়ির চাবিটা আপনি রাখেন।’ আজও মনে পড়ে, শৈশবে বাবার সামনে গেলে আমার সব দুষ্টুমি থেমে যেত। একটা দূরত্ব কাজ করত, হয়তো অভ্যাসের অভাবে, হয়তো ভেতরে জমে থাকা ভয় থেকে। সেই ভয়টাই ধীরে ধীরে ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে। বাবা, আপনি জানেন না, কিন্তু আমি আপনাকে অসীম ভালোবাসি।