দুই ছেলেকে পাঠানো হলো জুতা বেচতে, তারপর?
আজকাল নাকি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের (সিইও) বয়ানেও হতাশা প্রকাশ পাচ্ছে। টাইম ডটকমকে ক্লাউস ক্লাইনফিল্ড বলেছেন, ‘সিইওদের কথা শুনলে মনে হয়, ঠিক যেন পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।’
ও হ্যাঁ, ক্লাউস ক্লাইনফিল্ডকে একটু পরিচয় করিয়ে দেওয়া দরকার। সিমেন্স, অ্যালকোয়া গ্রুপের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ক্লাউস শুধু যে হতাশার কথা বলেছেন, তা নয়। জানিয়েছেন নেতৃত্বগুণের কিছু গোপন রহস্যও।
ভেতরের গুণাবলি
ক্লাউসের মতে, শুধু বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নেতৃত্ব হয় না। শরীর, মন, আত্মা—সব উজাড় করে দিতে হয়। ঠিক যেভাবে ফুটবল মাঠে লিওনেল মেসি কিংবা বাস্কেটবল কোর্টে লেব্রন জেমস মনেপ্রাণে উপস্থিত, অনেকটা তেমন।
শারীরিক সুস্থতার ব্যাপারে আজকাল কমবেশি সবাই সতর্ক। কিন্তু মানসিক শক্তি? মনোবল? এগুলো বিকাশের প্রতি কমই খেয়াল রাখি আমরা। ক্লাউসের মতে, ‘আত্মা’ বা আধ্যাত্মিক শক্তিই এখন সবচেয়ে অবহেলিত। অনেক অধিনায়কই বোঝেন না, সামান্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই নিজের আবেগগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব।
এসব কথা অনেকেই পাত্তা দিতে চান না। এ জন্যই ক্লাউস ক্লাইনফিল্ড টেনে আনেন এক জুতা বিক্রেতার উদাহরণ। তাঁর দুই ছেলে। জুতা বেচতে দুজনকেই নতুন এক দেশে পাঠানো হলো। বড় ছেলে হতাশ হয়ে ফিরে এসে বলল, ‘বাবা, খুব খারাপ অবস্থা। এই দেশে কেউ জুতাই পরে না। বেচাকেনা অসম্ভব।’ অপর দিকে ছোট ছেলে ফিরে এসে সুখবর দিল, ‘বাবা, এখানে কেউ জুতা পরে না। সবার কাছেই নতুন জুতা বেচা যাবে।’ এ গল্প থেকে বোঝা যায়—যেকোনো পরিস্থিতির ফলাফল নির্ধারিত হয় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। হতাশাবাদ যেমন মনোবল কমিয়ে দেয়, আশাবাদ ঠিক সেভাবেই মানসিক শক্তি জোগায়। খুব সহজেই নিজের মনকে আশাবাদী হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়।
শুধু কাজের পিছে ছুটে সাফল্য মেলে না। সবচেয়ে করিতকর্মা মানুষটিও অনবরত কাজ করলে ক্লান্ত হতে বাধ্য। এখানে আবার ক্রীড়াবিদদের উদাহরণ আনা যায়। টেনিস কোর্টে ফেদেরার কিংবা ক্রিকেট প্রাঙ্গণে টেন্ডুলকার কীভাবে পারতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই তেজ নিয়ে খেলতে? ক্লাউসের মতে, ক্রীড়াবিদেরা শরীরের পাশাপাশি মনকেও প্রশিক্ষণ দেন। ছোট ছোট কিছু কৌশল তাঁরা ব্যবহার করেন। ফেদেরারের জন্য যেমন টেনিস বলটি বাউন্স করাই ছিল ছোট্ট এক কৌশল। খেলার মাঠের বাইরেও এমন কিছু কৌশলই মনোবল রক্ষায় সাহায্য করতে পারে।
জার্মান দার্শনিক ফ্রিডরিখ নিৎসে বলেছিলেন, ‘যার জীবনে “কেন”–র উত্তর আছে, সে সব “কীভাবে”–র উত্তর জানে।’ জীবনের উদ্দেশ্যটা অত্যন্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এটা যেমন সময়ের সঙ্গে বদলাতে পারে, তেমনি একটির বেশিও হতে পারে। তাই নেতৃত্বকে ‘অভ্যন্তরীণ গুণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন ক্লাউস। তাঁর মতে, দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। অভ্যন্তরীণ গুণগুলো আয়ত্ত করতে পারলে বাহ্যিক গুণাবলি এমনিই প্রকাশ পাবে।
প্রয়োগ কীভাবে করব
মহৎ শিল্প শুরু হয় মহৎ দর্শন থেকে। মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠার আগেই বিল গেটস স্বপ্ন দেখেছিলেন—প্রতিটি ঘরে কম্পিউটার থাকবে। ডিজনির জনপ্রিয় কার্টুনগুলো জনসমক্ষে আসার আগেই ‘ডিজনিল্যান্ড’ বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন ওয়াল্ট ডিজনি। কিন্তু কর্মব্যস্ততার মধ্যে বড় কোম্পানিগুলো প্রায়ই এই দর্শন ভুলে যায়।
সিমেন্স ইলেকট্রনিকসের চিকিৎসা বিভাগে কাজ করার সময় ক্লাউস দেখেন, ব্যবসার অবস্থা করুণ। কর্মীদের অনুপ্রাণিত করতে তিনি তখন এমন এক গ্রাহককে খুঁজে বের করেন, সিমেন্স ইলেকট্রনিকসের তৈরি চিকিৎসা সরঞ্জাম যাঁর জীবন বাঁচিয়েছিল। সেই নারী একদিন সিমেন্সের অফিসে এসে প্রত্যেক প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদকে ধন্যবাদ জানান। ভেজা চোখে সেদিনের মিটিং শেষ করেন সিমেন্স মেডিকেলের কর্মীরা। দিন শেষে শ্রমিক ইউনিয়নের প্রধান এসে ক্লাউসকে বলেন, ‘আমাদের মানবতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।’
রোনালদো বিশ্বসেরা খেলোয়াড় হয়েও কখনো বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। বিজয়ী হওয়ার চেয়ে তাই বিজয়ীর দলে থাকা বেশি প্রয়োজন। ক্লাউসের জীবনের মন্ত্র তাই খুব সরল—মানুষ নিখুঁত হয় না, কিন্তু ঐক্য তাকে নিখুঁত করতে পারে।
নেতৃত্বের মৌলিক স্তম্ভগুলোর একটি হলো সম্মান। সম্মান দিতে এবং আদায় করে নিতে জানতে হয়। এ কারণেই ক্লাউসের কোম্পানির পরিচ্ছন্নতাকর্মীও তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেন না কখনো। কারণ, অফিসের কেউ তাঁদের সম্মান না দিলেও ক্লাউস ব্যতিক্রম।
ক্লাউসের বক্তব্য, ‘নেতৃত্ব বড় একাকী জায়গা। নিজের সত্যকে ঠিকভাবে জানলে, নিজের দলকেও সঠিক পথে এগিয়ে নেওয়া সহজ হয়। অভ্যন্তরীণ গুণগুলো আয়ত্ত করলে, তার বাহ্যিক প্রয়োগে সুযোগ্য নেতৃত্ব বের হয়ে আসতে পারে। এটা শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয়, জীবনের ক্ষেত্রেও সত্য।’