আইইউবিতে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র
শখের বসে মহাকাশ ভ্রমণ হোক বা মঙ্গলগ্রহে বসতি গড়া—দুনিয়াজুড়েই এ বিষয়ে আগ্রহ বাড়ছে। দেশের তরুণেরাও বসে নেই। এ–সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলোর দিকে তাকালেই তার প্রমাণ পাবেন। মঙ্গলগ্রহের জন্য রোভার, মহাকাশ গবেষণার জন্য অ্যাপ, নানা প্রতিযোগিতাতেই সাফল্য পাচ্ছেন আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এসব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ পড়ালেখা বা গবেষণার সুযোগ খুব একটা নেই। এ ক্ষেত্রে পথ দেখাতে পারে ‘সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি, স্পেস সায়েন্সেস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস’ (সিএএসএসএ বা কাসা)। মূলত জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মহাকাশ নিয়ে গবেষণার জন্যই ক্যাম্পাসে এই সেন্টারের কাজ শুরু করেছে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (আইইউবি)।
যেভাবে শুরু
কাসা প্রতিষ্ঠার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন আইইউবির সহকারী অধ্যাপক খান মুহাম্মদ বিন আসাদ। তিনি এই উদ্যোগের প্রধান প্রস্তাবক (প্রিন্সিপাল প্রপোজার)। জানতে চাইলাম, কোন ভাবনা থেকে কাজ শুরু করেছিলেন? বললেন, ‘শুরুতেই সেন্টার করার কথা ভাবিনি, কিন্তু গবেষণার জন্য একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান চেয়েছিলাম।’ উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরেই আইইউবিতে যোগ দেন আসাদ। ২০২০ সালের দিকে প্রথমে অ্যাস্ট্রোনমি রিসার্চ গ্রুপ (এআরজি) নামে একটি অনানুষ্ঠানিক দল খোলেন। সেটির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয় কিছু তহবিল। পেয়ে যান কম্পিউটিং সার্ভারও, যা এ ধরনের গবেষণার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৩-এ এআরজির নাম বদলে করা হয় কম্পিউটেশনাল অ্যান্ড অবজারভেশনাল অ্যাস্ট্রোনমি ল্যাব (কোল্যাব)। আসাদ বলেন, ‘স্বাধীন গবেষণা কেন্দ্র বা সেন্টারের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় ২০২৪-এ। কারণ তত দিনে ট্রাস্টি বোর্ড এবং জ্যেষ্ঠ ম্যানেজমেন্টের অনেকেই আমাদের কার্যক্রম বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে।’
খান মুহাম্মদ বিন আসাদই বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র জ্যোতির্বিজ্ঞানী। স্নাতকোত্তরে তিনি গ্যালাক্সি ক্লাস্টার পর্যবেক্ষণ, পিএইচডিতে ইউরোপের সবচেয়ে বড় রেডিও টেলিস্কোপ লো-ফ্রিকোয়েন্সি অ্যারে (এলওএফএআর) এবং পোস্ট ডকে এই টেলিস্কোপের আচরণ, প্রোপার্টি নিয়ে কাজ করেছেন। এসব গবেষণা এগিয়ে নেওয়াই তাঁর লক্ষ্য। শিক্ষার্থীদেরও তাই হাতে-কলমে শেখাচ্ছেন।
সেন্টারের আদ্যোপান্ত
‘সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি, স্পেস সায়েন্সেস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস’—নাম শুনেই বোঝা যায়, এর সঙ্গে তিনটি বিষয় যুক্ত। জ্যোতির্বিজ্ঞান, মহাকাশবিজ্ঞান ও জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান। তিনটির মধ্যে কোনটি নিয়ে কাজ হয় বেশি? আসাদ বলেন, ‘অ্যাস্ট্রোনমি ও অ্যাস্ট্রোফিজিকসই বেশি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ দুটি মূলত একই। যিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী, তিনিই জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান কমিউনিটি এবং স্পেস অ্যান্ড প্লানেটরি সায়েন্স (এসপিএস) কমিউনিটি আলাদা। এ দুটি কমিউনিটির একটা যৌথ জায়গা করাও ছিল আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।’
জ্যোতির্বিজ্ঞান, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান, কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং তড়িৎ প্রকৌশল—চারটি বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নিয়ে সেন্টারটি পরিচালিত হয়। আইইউবিতে কাসার অন্য দুজন মূল সদস্য (কোর মেম্বার) হলেন গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ, রিসার্চ অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস অফিসের পরিচালক ও অধ্যাপক এম আরশাদ মোমেন এবং তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক মুস্তাফা হাবিব চৌধুরী। সহযোগী সদস্য হিসেবে যুক্ত আছেন বেশ কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি জ্যোতির্বিজ্ঞানী। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলসলি কলেজের সহকারী অধ্যাপক লামীয়া আশরাফ মওলা, আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের শিক্ষক ও গবেষক সৈয়দ আশরাফ উদ্দিন, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্টডক্টরাল গবেষক আনোয়ার জামান।
এই গবেষকদের সঙ্গে দেশের শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হতে পারবেন। তহবিল থাকা সাপেক্ষে পাবেন আর্থিক সুবিধাও।
শিক্ষার্থীরা কীভাবে যুক্ত হবেন
আইইউবির এই সেন্টারে তিনভাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে। যেসব শিক্ষার্থী তাঁদের দ্বিতীয় বিষয় (মাইনর) হিসেবে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান বেছে নেবেন, তাঁরা কাজ করতে পারবেন। এ ছাড়া শিক্ষানবিশ বা গবেষণা সহযোগী হিসেবেও যুক্ত হওয়া যাবে। ২০২৩ সালে আইইউবিতে এই বিষয়ে মাইনর চালু হয়। ১০ জন শিক্ষার্থী তাঁদের পড়া শেষ করেছেন। বর্তমানে পড়ছেন আরও ১৫ জন।
জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে ‘আওয়ার কসমিক হিস্টোরি’ নামে একটি কোর্স চালু আছে আইইউবিতে। সেটিও এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে।
আইইউবির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের দশম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মো. শাহাদাৎ হোসেন। মাইনর করছেন জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে। মুঠোফোনে তিনি বলছিলেন, ‘একবার নাফাখুম ট্রেইলে গিয়েছিলাম। বান্দরবানের গভীরে সেই তারাভরা রাতেই জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহ জন্মে। আইইউবিতে এসে “দুরবিন” নামে একটি প্রজেক্টে যুক্ত হই। সেখানে আসাদ স্যার ও লামীয়া আশরাফ মাওলা আপুর সান্নিধ্যে আসি। পরে অ্যাস্ট্রোনমিতে মাইনর চালু হলে, সেই সুযোগও নিয়েছি।’
গবেষণা করার প্রক্রিয়া তিনি এখানে হাতে–কলমে শিখেছেন। সেন্টারের সহযোগী সদস্যদের মাধ্যমে বিশ্বের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে রেডিও গ্যালাক্সি ক্ল্যাসিফিকেশন বা নিজেদের বানানো রেডিও টেলিস্কোপ স্থাপন, সবই শিখেছেন কাছ থেকে।
কাসার নানা কার্যক্রম
কানাডার টরন্টো থেকে পাওয়া দুটি টেলিস্কোপ দিয়ে একটি প্রকল্প চালু হয়েছে আইইউবিতে। নাম দেওয়া হয়েছে দুরবিন, দূর বিশ্বের নাগরিকের সংক্ষেপিত রূপ। এই পোর্টেবল টেলিস্কোপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অন্ধকার জায়গা (ডার্ক লোকেশন) থেকে গ্যালাক্সি ও নেবুলার ছবি তোলেন। এখানে কাজ মূলত দুই ধরনের। একাডেমিক ও নন একাডেমিক। যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ–সংক্রান্ত বিষয়ে পড়তে চান না বা জ্যোতির্বিজ্ঞানী হতে চান না, কিন্তু আকাশ নিয়ে আগ্রহ আছে, তাঁরাও দুরবিন প্রকল্পের অংশ হতে পারেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বর্তমানে দুরবিনের আছে জাতীয় পর্যায়ের দল ও এলাকাভিত্তিক চ্যাপটার।
সম্প্রতি কাসার একটি কর্মশালায় দেশের ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন। সেন্টারের কার্যক্রম নিয়ে ধারণা দেওয়ার পাশাপাশি আগ্রহীদের যুক্ত করতেই এই উদ্যোগ। দেশে বা দেশের বাইরে কাসায় যুক্ত গবেষকদের সঙ্গে যাঁরা গবেষণা করতে চান, তাঁরা এই সেন্টারে বসেই সেটা করতে পারবেন।
এ ছাড়া কাসার সদস্যরা দেশে বসেই একটি রেডিও টেলিস্কোপ তৈরি করেছেন। নাম দিয়েছেন স্মল ট্রানজিয়েন্ট অ্যারে রেডিও টেলিস্কোপ (স্টার্ট)। কথা বলে জানা গেল, দেশের বাইরে পোস্ট ডকে পড়ার সময় একটি প্রকল্পে কাজ করেছিলেন খান আসাদ। ওই প্রকল্পে ব্যবহৃত নিউজিল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি ইলেকট্রনিক অংশের নকশাকে তাঁরা ব্যবহার করেছেন। আমদানী করতে হয়েছে ইলেক্ট্রনিক রিসিভার ও ২৫টি অ্যানটেনা। তবে এই রিসিভার ও অ্যানটেনা বসানোর জন্য যে কাঠামো প্রয়োজন হয়, তা দেশেই তৈরি করা হয়েছে। এই ধরনের টেলিস্কোপ মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার কাজেই ব্যবহৃত হয়। খরচ কম হওয়ায় দেশে বানানো এই টেলিস্কোপের অ্যারে কাঠামোর নকশা বানিয়ে নিতে দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডের গবেষকেরাও আগ্রহ দেখিয়েছে।
স্বপ্ন বহুদূর
আসাদ স্বপ্ন দেখেন, দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, পুরো এশিয়া অঞ্চলে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত পাবে কাসা। এ জন্য অবশ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং মহাকাশবিজ্ঞানীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। সেই পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে বলে জানালেন তিনি।
তবে এই সেন্টার প্রতিষ্ঠার পথ সহজ ছিল না। কারণ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স ও তার চাহিদাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চাহিদা না থাকলে সেন্টার তো দূর, একটি কোর্স চালু রাখাও সম্ভব নয়। তাই ধাপে ধাপে এগোতে হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর চালু করার প্রক্রিয়াও চলমান আছে।
আন্তর্জাতিক অ্যাস্ট্রোনমিকাল ইউনিয়ন ও স্কয়ার কিলোমিটার অ্যারের (এসকেএ) মতো বড় বড় সংস্থার আনুষ্ঠানিক সদস্যপদ পাওয়াই বড় লক্ষ্য এই সেন্টারের। সেন্টারটির কাজ চালু থাকলেও খাতা–কলমে এখনো এটি প্রস্তাবিত হিসেবে উল্লেখ আছে। আসাদ জানালেন, দ্রুতই আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পাওয়ার আশা করছেন তাঁরা।