‘তুমি কি লিখতে গিয়ে দেরি করে ফেলেছ’

পাঠকই প্রথম আলোর প্রাণ। আর পাঠকের আপন আঙিনা ‘ছুটির দিনে’। প্রথম আলোর রজতজয়ন্তীতে তাই আমরা পাঠকের লেখা নিয়েই হাজির হয়েছি। তাঁদের কেউ জানিয়েছেন ‘ছুটির দিনে’তে পড়া হৃদয়ছোঁয়া কোনো লেখার কথা। কেউ স্মৃতির ঝাঁপি খুলেছেন স্বনামে প্রকাশিত লেখা নিয়ে, জানিয়েছেন প্রিয় ক্রোড়পত্র নিয়ে নিজের ভালো লাগার কথাও। পড়ুন এমন একটি লেখা।

পাহাড়ের এক ছোট গ্রাম থেকে কলেজ পাস করে শহরে এসে তখন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির কোচিং করছি। ২০০৪ সালের সেই সময়টায় ‘ছুটির দিনে’র ‘ঘর মন জানালা’ বিভাগে আমার একটা লেখা ছাপা হয়। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরোটা সময় আমার ‘ছুটির দিনে’র সঙ্গে কেটেছে। তখন ফিচার পাতায় লেখা ছাপা হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তারকা হয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার ছিল। অনেকেই ফোন করত, দেখা করতে আসত, এমনকি বিভিন্ন ছোটখাটো উপহারও নিয়ে আসত।

প্রথম বর্ষে পড়ার সময় আমরা একদিন ঝুপড়িতে আড্ডা দিচ্ছি। আমাদের এক বছরের সিনিয়র এক ভাই এসে আমার এক বন্ধুকে বলল, ‘আজকে তো জুয়েলের লেখা ছাপা হয়েছে।’

তিনি আমাকে চেহারায় চিনতেন না। আমার বন্ধুরা তখন আমাকে দেখিয়ে দিলে তিনি লজ্জা পেয়ে যান।

আমাকে অনেক মেয়ে বলেছে, মেয়েদের হলে আমার লেখা পড়ত রীতিমতো কাড়াকাড়ি করে! বিভাগের স্যাররাও ‘ছুটির দিনে’র লেখার কারণে চিনতেন। একদিন ক্লাসে ঢুকতে দেরি করে ফেলেছিলাম। দরজার সামনে গিয়ে স্যারের অনুমতি চাইলে নির্মল স্যার হেসে বললেন, ‘তুমি কি কোনো লেখা লিখতে গিয়ে দেরি করে ফেলেছ!’

ছুটির দিনে’তে প্রকাশিত জুয়েল দেবের একটি লেখা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে আসা পাঁচ বছরের শিক্ষাজীবনের বহু স্মৃতির সঙ্গে ‘ছুটির দিনে’ জড়িয়ে আছে। এই ক্রোড়পত্রে আমার অনেক লেখা ছাপা হয়েছে। ছোট ছোট সব লেখা। তাতেই অনেক পরিচিতি। ২০১৪ সাল পর্যন্ত নিয়মিত লিখেছি। তখন ঈদের সময় অণুগল্প লেখার প্রতিযোগিতা হতো। আমার কয়েকটা অণুগল্প সেরা লেখা হিসেবে ছাপা হওয়ায় প্রথম আলো থেকে কয়েক হাজার টাকার প্রাইজবন্ডও পেয়েছিলাম। এই প্রাইজবন্ড আনার জন্য ঢাকায় প্রথম আলো অফিসেও গিয়েছি। ‘ছুটির দিনে’র তখনকার বিভাগীয় সম্পাদক ইকবাল হোসাইন চৌধুরীর সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। এমনকি সম্ভবত ফোনেও কখনো কথা হয়নি।

তখন রাস্তাঘাটে ঘুরে ঘুরে যা দেখতাম, তাই নিয়েই ছোট ছোট সব ফিচার লিখতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বন্ধুরা সবাই টিউশন শেষ করে এসে সন্ধ্যায় আড্ডা দিতাম নাসিরাবাদ স্কুলের সামনে। রাস্তার পাশে বেলাল ভাইয়ের টংদোকান ছিল। বেলাল ভাইয়ের দুই ছেলে রাজা আর বাদশা। ওরা সারা সন্ধ্যা দোকানের আশপাশে দৌড়াদৌড়ি করে। ঈদুল ফিতরের কিছুদিন আগে এই দুই ভাইকে নিয়ে আমার একটা লেখা ছাপা হয় ‘ঘর মন জানালা’ বিভাগে। ওই লেখা পড়ে কয়েকজন লোক তাদের ঈদের জামা উপহার দিয়েছিল। বেলাল ভাই আমাকে বলেছিলেন, দুই ভাই হাজার দশেক টাকার মতো উপহার পেয়েছে। এটা আমার জন্য রীতিমতো আপ্লুত হওয়ার মতো বিষয় ছিল।

২০১২ সালে তুলাতলি বস্তিতে পথশিশুদের জন্য একটা স্কুল চালু হয়। আমি সেই স্কুল দেখে এসে একটা লেখা লিখে পাঠাই। ‘ছুটির দিনে’তে ৫ মে ‘চারুলতা বিদ্যাপীঠ’ নামে ছাপা হওয়া সেই ছোট লেখা স্কুলটার ওপর ভালোই প্রভাব ফেলেছিল। অনেকেই স্কুলটার ব্যাপারে জেনেছিলেন, সহযোগিতা করেছেন। এখনো বহাল তবিয়তে চালু আছে এই স্কুল। প্রায় দেড় শ শিশু সেখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে চারুলতা বিদ্যাপীঠ নিয়ে প্রথম আলোতে বেশ কয়েকটা ফিচার প্রকাশিত হয়েছে।

প্রতি শনিবার আমরা ‘ছুটির দিনে’র জন্য অপেক্ষায় থাকতাম। মূল পত্রিকার সঙ্গে ফ্রি পাওয়া সেই ম্যাগাজিন বা পরে ট্যাবলয়েড আমাদের জন্য তীব্র আকর্ষণীয় ছিল। আমি যেসব লেখা পাঠিয়েছি, তার বেশির ভাগই ছাপা হয়নি। তবে অন্য যাদের লেখা ছাপা হতো, সেগুলো পড়ে নিজের লেখা ছাপা না হওয়ার দুঃখটা আর থাকত না।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার অনেক দিন পর পর্যন্তও ‘ছুটির দিনে’তে আমার লেখা ছাপা হয়েছে। একবার চাকরির পরীক্ষা দিতে আমরা বন্ধুরা সব চট্টগ্রাম থেকে একসঙ্গে ঢাকা যাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সবাই ছিলাম। সেখানে একটা ছেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে দরজার সামনে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। পরে জানতে পারলাম অসম্ভব জ্বর নিয়ে সে চলে এসেছে। তাকে উল্টো আমাদের সেবাশুশ্রূষা করে ভালো করতে হলো।

আমার তারুণ্যের একটা বড় অংশের উজ্জ্বল স্মৃতি ‘ছুটির দিনে’র ‘ঘর মন জানালা’ বিভাগ।