মিডলাইফ ক্রাইসিস কেন হয়, সামলাতে রইল ৯টি কার্যকর পরামর্শ
মিডলাইফ বা মাঝবয়স বড্ড জটিল এক সময়। সবকিছু আছে, তবু মনে হবে কী যেন নেই। আশপাশে প্রচুর মানুষ, তবু মনে হবে চারদিকে শূন্যতা। ভাবনার কার্নিশজুড়ে থাকবে অযাচিত বিষণ্নতা। মন খারাপ, কিন্তু কেন—সেটার উত্তর জানা নেই। এই বয়স একদিকে যেমন পরিপক্বতার, অন্যদিকে রহস্যাবৃত মন নিয়ে দ্বিধার আধার। যেন মহাশূন্যে নিজেকে হারিয়ে খুঁজে ফেরা।
মিডলাইফ ক্রাইসিস কী
মিডলাইফ ক্রাইসিস বলে আদতে কিছু আছে কি না, এটা নিয়ে চিকিৎসক ও মনোবিদেরা যুক্তিতর্ক করলেও কোনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। তবে আলোচনা ও উপাত্ত থেকে এটা স্পষ্ট যে মিডলাইফ ক্রাইসিস কোনো মানসিক সমস্যা নয়। গবেষণায় দেখা যায়, সাধারণত ৪০-৬০ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে সুখানুভূতি হ্রাস পায়।
কেউ যখন বুঝতে পারেন বয়স বাড়ছে, শারীরিক সৌন্দর্য লোপ পাচ্ছে, তখন অনেকে তা মেনে নিতে পারেন না। এতে তাঁর ভেতর একধরনের দোটানা কাজ করে। চাকরি, ব্যবসা ও অন্যান্য পেশাগত কাজে নিয়োজিত অনেকেই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নিজের অবস্থানের তুলনা করেন। তখন তুলনামূলক কম সফল বা সমস্যায় থাকা মানুষেরা নিজেদের ব্যর্থ ভাবতে শুরু করেন। পাশাপাশি আর্থিক দীনতা, অসুস্থতা, সাংসারিক জটিলতা ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয় তাঁদের চিন্তায় জায়গা করে নেয়, যা থেকে কেউ কেউ ডিপ্রেশনে পড়েন।
সামলাবেন যেভাবে
মাঝবয়সের এই মন-কেমন-করা অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কিছু বিষয় সচেতনভাবে চর্চা করতে পারেন। এর মধ্যে আছে—
নিজের যত্ন নেওয়া: বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাঝবয়সে এসে আমরা পরিবারের সবার খেয়াল রাখতে গিয়ে নিজেদের খেয়াল রাখি না। এমনকি নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগা ও সুখ বিসর্জন দিই। মনে রাখতে হবে, পরিবারের অন্যদের পাশাপাশি নিজের খেয়াল রাখাও জরুরি। কেননা নিজে ঠিক না থাকলে অন্যদের যত্ন নেওয়া সম্ভব নয়।
জীবনের মানোন্নয়ন: মাঝবয়সে অনেক পরিবর্তন আসতে পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক। আপনি যে অবস্থায় আছেন, সেখান থেকে কীভাবে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করবেন, তা নিয়ে ভাবুন। সমস্যা থেকে উত্তরণের পদক্ষেপগুলো নোট করুন। দীর্ঘদিন মানুষ নিজের কমফোর্ট জোনে থেকে অভ্যস্ত হয়ে যান। তাই মাঝবয়সে এসে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে চান না। অথচ নিজের জীবনমানের উন্নতি চাইলে আপনাকে নিয়মিত চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। তাই নিজেকে সফল হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে সব বয়সেই নতুন শেখার, নতুন কিছু করার আগ্রহ থাকা জরুরি।
নতুন কিছু রপ্ত করা: নতুন কিছু শেখা ও জানার মধ্যে একটা অন্য রকম আনন্দ আছে। এটা মনকে পুলকিত করে। কখনো কখনো আনন্দের পাশাপাশি সাফল্যের অনুভূতিও এনে দেবে। যেমন আপনি ইচ্ছে করলে নতুন ভাষা শিখতে পারেন, অনলাইনে পছন্দের কোর্স করতে পারেন, রান্না শিখতে পারেন অথবা করতে পারেন আউটসোর্সিং।
নেটওয়ার্কিং: চিকিৎসক ও গবেষকেরা বলছেন, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগ খুব গুরুত্বপূর্ণ। যাঁদের সঙ্গে থাকলে আপনার সময় ভালো কাটে, মন ভালো হয়, তাঁদের নিয়ে আড্ডা দিতে পারেন। দূরে থাকলে ফোন করতে পারেন। পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা আপনাকে ভালো থাকতে সাহায্য করবে।
ভালোবাসায় বাঁচুন: দাম্পত্য জীবনের নানা সমস্যা এ সময়েই বেশি মাথাচাড়া দেয়। এর মধ্যে মতের অমিল, দাম্পত্য কলহ, বিবাহবিচ্ছেদ ও যৌন শীতলতা উল্লেখযোগ্য। আপনি আপনার সঙ্গীর কাছ থেকে কী চান, তা স্পষ্ট করে বলুন। বিশেষ দিনে ফুল কিংবা উপহার দিন। রোমান্টিক ছুটির পরিকল্পনা করুন। মাঝেমধ্যে একসঙ্গে লাঞ্চ বা ডিনারে বেরিয়ে পড়ুন। এতে পারিবারিকভাবেও আপনার ভালো সময় কাটবে।
নিজেকে সক্রিয় রাখুন: শারীরিক ব্যায়াম আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক। এটা মনোযোগ তীক্ষ্ণ করে ও মানসিক চাপ কমায়। সাইক্লিং বা দৌড় নিয়মিত রুটিনে থাকলে বিরক্তিকর লাগতে পারে। তাই বৈচিত্র্যের জন্য জিম করুন, সাঁতার কাটুন, ট্রেকিং কিংবা খেলাধুলা করুন। শরীর যদি অসাড় হয়ে না পড়ে, তাহলে আপনার মনেও অসুখ বাসা বাঁধতে পারবে না।
স্বাস্থ্যকর অভ্যাস: স্বাস্থ্যকর অভ্যাস শুরু করার জন্য মাঝবয়স আদর্শ সময়। আপনার পুরো জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার দরকার নেই। ছোট ছোট জায়গা পরিবর্তনের জন্য বেছে নিন। প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করতে পারেন, বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার আনতে পারেন, প্রতিদিন সকালে ফল এবং পুষ্টিকর খাবার খান।
বেড়ানো: বাইরে সময় কাটানো মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, তাই দূরে কোথাও ঘুরে আসুন। হাঁটাহাঁটি করুন; এতে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, যা আপনাকে কর্মচঞ্চল রাখবে। ক্যাম্পিংয়ে যেতে পারেন। নানা রকম ভ্রমণের দল হয়েছে আজকাল। আপনি এসব দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরতে পারেন। পরিবারের বাকিরা ব্যস্ত থাকলেও সমস্যা হবে না আপনার বেড়ানোতে। এসব দলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ালে বরং আপনি নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হবেন, মনটাও থাকবে ফুরফুরে।
পছন্দের কাজ করা: জীবনের এ সময়ে এসে পেশাগত কাজে বিরক্তি জন্মানো স্বাভাবিক। মাঝেমধ্যে মনে হবে, একই কাজ করে যাচ্ছি বছরের পর বছর ধরে! চাকরি বোরিং, ছেড়ে দিই। কিন্তু ভাবুন, এটাই কি সমাধান? বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবনের মাঝামাঝি সময়টা পেশাগত কাজের সঙ্গে সঙ্গে পছন্দের কাজ করারও আদর্শ সময়। যে কাজটা তারুণ্যে অন্য কাজের চাপে করতে পারেননি, এখন সেই ভালোবাসার কাজটাও করুন। কারণ, পেশাজীবনে আপনি এখন অভিজ্ঞ, তাই আগের মতো বাড়তি সময় খরচ হবে না। বরং বাড়তি সময়টুকু এবার ভালোবাসার কাজে দিন। সেটা হতে পারে ছবি আঁকা, লেখালেখি, আবৃত্তি, সংগীতচর্চা, ফটোগ্রাফি ইত্যাদি।
আগামী বছরগুলোয় জীবনকে আরও উপভোগ্য করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকুন। এতে মাঝবয়সের আলসেমি, বিষণ্নতা উবে যাবে। বরং এ সময়ে এসে নিজেকে মনে হবে আরও সফল ও সুখী মানুষ।