অভিভাবক নয়, মা শুধু সন্তানের জিম্মাদার!

একজন মায়ের জন্য ‘জিম্মাদার’ শব্দটি সত্যিই অপমানের। বাচ্চাকে যিনি পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন, শত বিপদেও ফেলে যাননি, তার খাওয়াদাওয়া, লেখাপড়া, আবদার, ঘোরাঘুরিসহ সব দাবি তিলে তিলে মিটিয়েছেন, তিনিই মা। অন্য রকম মা–ও সমাজে কিছু আছেন, সন্তান ফেলে রেখে যাঁরা বাড়ি ছেড়ে চলে যান, তাঁদের কাছে সন্তান যে নিরাপদ নয়, সেটি আদালতে গিয়ে প্রমাণ করার কিছু নেই, আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা সন্তানের অভিভাবক হতেও চান না। কিন্তু যে মা তাঁর জীবনের সব শখ ও স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে লড়াই করতে থাকেন, তাঁকে বিবাহবিচ্ছেদের পর আদালত অভিভাবকত্ব দেন না, দেন জিম্মাদারি। বাংলাদেশ অভিভাবক এবং প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০-এর ১৭ [ক] ধারা অনুযায়ী নাবালক সন্তানের জিম্মাদার করা হয়েছে মাকে আর বাবাকে অভিভাবক। ছেলেসন্তান ৭ বছর পর্যন্ত আর মেয়েসন্তান বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকবে।

ঘটনাটা তবে কী দাঁড়াল, সন্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় অর্থাৎ যে সময়টা তারা হাত দিয়ে বেড়ে খেতে পারবে না, নিজে নিজে টয়লেট করতে পারবে না, একা একা কোথাও যেতে পারবে না; সেই সময়টুকুর জন্য মা তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকা পালন করবেন; আর বড় হয়ে যাওয়ার পর যে সময়টা সন্তান একাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কারও সাহায্যের দরকার নেই, সেই সময়টা বাবার কাছে থাকবে। এই সময়টুকু বাবা কেবল অর্থের জোগান দেবেন, সন্তানের প্রস্রাব–পায়খানা পরিষ্কার না করলেও তিনি অভিভাবক। মা কি তাহলে বাচ্চা উৎপাদন ও পালন করার যন্ত্র, সেটিই আমার প্রশ্ন! এর বাইরেও যে লোক বাচ্চাটিকে জন্ম দিয়ে গেলেন, এরপর আর কোনো খোঁজ নিলেন না; কিংবা ধরুন, একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলেন, তাঁর গর্ভে যে বাচ্চাটি এলো, তার পিতৃপরিচয় কি তাহলে ওই ধর্ষকই বহন করবেন? তিনিই হবেন অনাগত সন্তানের অভিভাবক!

সে জন্যই এই ২০২২ সালে এসেও দেখা যায়, গ্রামে যদি কোনো নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন, তাহলে তাঁকে নির্যাতনকারী ব্যক্তির সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়, যাতে পরে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে কোনো একজন পুরুষের নাম লেখা যায়। আমাদের প্রচলিত নিয়মে নারীকে কখনোই কোথাও অভিভাবকত্ব দেওয়া হয়নি, কেউ যদি সেটি প্রার্থনা করেন, সেই আরজি নিয়ে যেতে হয় পারিবারিক আদালতে। মায়ের পক্ষে অভিভাবকত্ব চাওয়ার মামলা যদিও কোর্টে ওঠে, তার রায় হতে হতে বাচ্চা সাবালক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে যায় অথবা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার বয়স হয়ে যায়। আর মা নামের ‘সচল যন্ত্রটি’ তত দিনে অর্থ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন।

পৃথিবীর অনেক দেশে ও অনেক ধর্মে কোনো কারণে মা–বাবা আলাদা হয়ে গেলে দুজনকেই অভিভাবক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যেন একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যজন দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কেউ যদি স্বেচ্ছায় তা গ্রহণ না করতে চান, সেটি তার বিষয়; আর দুজন একসঙ্গে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে তা পারিবারিক বা সামাজিকভাবে আলোচনা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায়, যিনি সন্তানের কোনো দায়িত্ব নিলেন না, শুধু কাগজে–কলমে মা অথবা বাবা হয়ে থাকলেন, সে ক্ষেত্রে সন্তান মহাবিপদে পড়ে যায়, উন্নত চিকিৎসা বা শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যেতে চাইলে দুজনেরই সম্মতি প্রয়োজন হয়; আর যদি তাঁদের একজনকে না পাওয়া যায়, তাহলে দ্বারস্থ হতে হয় আদালতের।

অভিভাবক হওয়ার অধিকার যদি মা–বাবার সমান থাকত, তাহলে কোনো একজন অভিভাবক মারা গেলে বা পালিয়ে গেলে অন্য একজন সহজে দায়িত্ব নিতে পারতেন। তাই আমি মনে করি, আধুনিক সময়ের কথা বিবেচনা করে অভিভাবকত্বের এই প্রাচীন আইন বদলে ফেলার সময় এসেছে। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই অধিকার এখন মাকে দিচ্ছেন আদালত। তবে এটা নির্বিশেষে সব মাকেই দেওয়ার সময় মনে হয় এসেছে।