অপহরণকারীকে বিয়ে করেও শেষ রক্ষা হলো না, সন্তানদের নিয়ে সুবর্ণার ঠিকানা এখন শিশুপল্লি

ফাইল ছবি

শিশুপল্লি প্লাসের এক সভায় গত ২৬ নভেম্বর সুবর্ণা আক্তারের সঙ্গে পরিচয়। দুই সন্তান নিয়ে গাজীপুরের এই মা ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রেই এখন থাকেন এই মা। সাংবাদিক পরিচয় জেনে নিজের সঙ্গে ঘটা অন্যায়ের বিস্তারিত শোনালেন সুবর্ণা।

২০১৭ সালের দিকে সিলেটের খাদিমনগর এলাকায় থাকতেন সুবর্ণা। তখন তিনি স্নাতকের শিক্ষার্থী। পড়াশোনাসহ নিজের খরচ মেটাতে গৃহশিক্ষকতা করতেন। একপর্যায়ে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পান। এক বিকেলে কর্মস্থল থেকে বাসায় ফেরার জন্য গাড়ির অপেক্ষায় ছিলেন। হঠাৎ কেউ একজন তাঁর মুখে রুমাল চেপে ধরলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন সুবর্ণা। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে একটি তালাবদ্ধ ঘরে আবিষ্কার করেন, সেখানে ছিলেন আরও ছয় নারী। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারেন, তাঁরাও অপহরণের শিকার।

কিছুক্ষণের মধ্যে অচেনা চারজন লোক এসে তাঁদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। প্রত্যেক পরিবারের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে মুক্তিপণ দাবি করে। সুবর্ণার পরিবার যথাসময়ে মুক্তিপণ দিতে পারেনি। ফলে ১২ দিন তালাবদ্ধ ঘরে বন্দী ছিলেন তিনি। বাকি ছয়জনের চারজনকে বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়। মুক্তিপণের বিনিময়ে দুজনকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয় অপহরণকারীরা। একপর্যায়ে সুবর্ণাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে অপহরণকারীরা। বাধা দেওয়ায় তাঁকে প্রচণ্ড মারধর করে তারা। পরে অপহরণকারীদের একজন, নাম আবদাল মিয়া, সুবর্ণাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। প্রথমে রাজি না হলেও জীবন বাঁচাতে পরে রাজি হয়ে যান সুবর্ণা। ৫০ হাজার টাকা দেনমোহরে সুবর্ণাকে বিয়ে করেন আবদাল।

সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার গোয়ালাবাজার গ্রামের বুদাই মিয়ার ছেলে আবদাল মিয়া। এলাকায় জয় এবং শুভ নামেও তিনি পরিচিত। সুবর্ণা বলেন, ‘বিয়ের পরও আমাকে বন্দী করে রাখা হয়। কিছুদিন পর আমাকে নিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে যায় আবদাল। অপহরণকারীকে বিয়ে করায় নিজের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছিলাম।’

গ্রামে থাকার সময় বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান আবদাল। অপহরণও চালিয়ে যান। বিভিন্ন অন্যায় কাজে জড়িত থাকার দায়ে সাতটি মামলার আসামি হন আবদাল। গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন কয়েকবার। ছাড়া পেয়ে ছোট ছোট বিষয় নিয়ে প্রায়ই সুবর্ণাকে মারধর করতেন। এর মধ্যেই প্রথম সন্তানের জন্ম দেন সুবর্ণা। বছরখানেক পর আরও একটি সন্তান হয়। এভাবে ছয় বছরের মতো টিকে ছিল তাঁদের সংসার।

সুবর্ণা বলেন, ‘দুই মাস আগে পারিবারিক একটি বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। এর জের ধরে আমার ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন চালায় সে। তার দায়ের কোপে জখম হয় শরীরের বেশ কয়েকটা জায়গা।’ একপর্যায়ে তাঁকে অ্যাসিডে ঝলসে দেওয়ার চেষ্টা হয়। ধস্তাধস্তিতে সুবর্ণার পেট ও শরীরের বিভিন্ন অংশে অ্যাসিড ছড়িয়ে পড়ে। ঝলসে যায় শরীরের বেশ কিছু জায়গা। কেটে দেওয়া হয় মাথার চুল। এমন অবস্থায় দুই সন্তান নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে হাসপাতালে চলে যান।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুবর্ণা তাঁর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। চিকিৎসা শেষে আবদালকে আইনগতভাবে তালাক দেন সুবর্ণা। পরে সুবর্ণা বাদী হয়ে আবদালের বিরুদ্ধে ওসমানীনগর থানায় মামলা করেন। মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার ২৫ দিন পর জামিনে বের হয়ে আসেন আবদাল। বের হয়েই মামলা দেওয়ায় সুবর্ণাকে হত্যার হুমকি দেন। এমন অবস্থায় ‘শিশু পল্লী প্লাস’ প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পান সুবর্ণা। ১ নভেম্বর থেকে সেখানেই আছেন সুবর্ণা।

পরে সুবর্ণার বিষয়ে মুঠোফোনে তাঁর বাবা মইন উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এখানে থাকলে (কোম্পানীগঞ্জ) স্বর্ণাকে মেরে ফেলবে। মামলা করায় বিভিন্নভাবে আমাকে ও আমার পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিচ্ছে আবদাল। আমার মেয়েকে কুপিয়ে ও অ্যাসিড দিয়ে ঝলসে জীবন প্রায় শেষ করে দিয়েছিল। মেয়ের সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। তার জীবনে নিরাপত্তার জন্য মা ও শিশু আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। এখন বিচার দেখার অপেক্ষায় আছি।’

সুবর্ণার দায়ের করা মামলার তদন্ত করছেন সিলেটের ওসমানীনগর থানার উপপরিদর্শক আকরাম হোসেন। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সুবর্ণার বর্ণনা সঠিক। তাঁকে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়েছে। আবদালের বিরুদ্ধে সাত-আটটি মামলা আছে। এমন কোনো মাস নেই যে সে জেলে যায় না। আবদালের বিষয়ে একই তথ্য দিয়েছেন ওসমানীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম মাঈন উদ্দিন।

জীবনের গল্প বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন সুবর্ণা, ‘একজনের জন্য কয়েকটা জীবন কীভাবে নষ্ট হয়, নিজের জীবন শেষ করে সেটা জেনেছি। এমন দুর্বিষহ জীবন যেন কোনো নারীর না হয়। আমার জীবন নষ্ট করার বিচার কি পাব?’