এক দিন পর ‘প্রথম আলো’ হাতে পেয়ে চোখ ভিজে গিয়েছিল

প্রথম আলো নিয়মিত পড়ার পাশাপাশি সংরক্ষণও করেন চুয়াডাঙ্গার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সালমা খাতুনছবি: প্রথম আলো

১৮ ডিসেম্বর রাতে দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দেখি, হকার পত্রিকা দিয়ে যায়নি। সাধারণত সকাল আটটার মধ্যেই কাগজ চলে আসে। ভাবলাম, হয়তো হকার অসুস্থ বা কনকনে শীতের কারণে তাঁর আসতে দেরি হচ্ছে। অভ্যাসবসত আগের দিনের কাগজটা খুলে পড়লাম। সন্দেহের চোখে দেখলাম, পত্রিকা বন্ধের কোনো ঘোষণা আছে কি না। না, তেমনটি কোথাও লেখা নেই।
সকাল ১০টার দিকে আমার স্বামী খবর পেলেন তাঁর বড় ভাই নাজমুল আরেফিনের কাছে, প্রথম আলোতে হামলা হয়েছে। রাতে প্রথম আলো অফিসে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট করা হয়েছে। খবরটা শুনে বুকটা কেঁপে উঠল। মনে হচ্ছিল, পত্রিকাটি বুঝি সহসা আর হাতেই পাব না।

কিন্তু এক দিন বাদে শনিবার সকালে যখন আবার প্রথম আলো হাতে পেলাম। কী যে অনুভূতি, ভাষায় বোঝানো যাবে না। মনে হচ্ছিল, কোনো প্রিয় মানুষ ফিরে এসেছে!
ভাবলাম, কী অসম্ভব দৃঢ়তা এই পত্রিকার! এমন হামলার পরও আবার দাঁড়িয়ে যাওয়া, এটা শুধু সংবাদপত্রের কাজ নয়, এটা একটা দায়িত্ববোধ।

আমি নিয়মিত প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয় পড়ি। খেলার পাতাও বাদ যায় না। শুক্রবারের সংখ্যা তো আমার কাছে বিশেষ দিন, বিশেষ করে গোল্লাছুট। ধর্মীয় লেখাগুলোও মন দিয়ে পড়ি। প্রথম পাতায় যেভাবে দেশের মানুষের কথা উঠে আসে, তা অন্য পত্রিকায় সচরাচর দেখা যায় না। খবরের ভাষা, উপস্থাপন—সবকিছুতেই একটা দায়িত্ববোধ থাকে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় প্রথম আলোর ভূমিকা ছিল খুবই সাহসী। গাজার ঘটনাগুলো নিয়ে যেভাবে লেখা হয়েছে, সেগুলো পড়ে বহুদিন চোখ ভিজে ছিল।
আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেছি, বছরের পর বছর ধরে কীভাবে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন গোষ্ঠী সক্রিয় হয়েছে। ক্ষমতাবানেরা কত চেষ্টা করেছে পত্রিকাটিকে দমিয়ে রাখতে, কিন্তু পারেনি।
১৮ ডিসেম্বর রাতে যা ঘটেছে, তা নজিরবিহীন। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির হত্যার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর একদল সন্ত্রাসী প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট, উদীচীর মতো প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করে। এটা শুধু একটি পত্রিকা বা প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার ওপর আঘাত নয়, এটা সত্যের ওপর আঘাত।

আজও প্রথম আলো সংরক্ষণ করে চলেছেন কামরুল আরেফিন ও সালমা খাতুন
ছবি: প্রথম আলো

২৭ বছরের সঙ্গী

১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর উদ্বোধনী সংখ্যা বের হয়। তবে এর মাসখানেক আগে একটি বুলেটিন প্রকাশ করেছিল পত্রিকাটি। সেই বুলেটিনেই সম্পাদক মতিউর রহমান পাঠকের প্রতি যে দায়বদ্ধতার কথা বলেছিলেন, সেটাই আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। মনে হয়েছিল, এই পত্রিকা আলাদা কিছু করতে চায়।
তারপর কেটে গেছে ২৭ বছরের বেশি সময়। এই দীর্ঘ সময়ে প্রথম আলোর একটি সংখ্যাও আমি ফেলে দিইনি। সব সংরক্ষণ করেছি। আমার স্বামী কামরুল আরেফিনের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েই বাড়ির দুটি ঘর ছেড়ে দিয়েছি পত্রিকা রাখার জন্য।
আজও প্রতিদিন সকালে কাগজটা হাতে নিই। আগের মতোই যত্ন করে রাখি। জানি না ভবিষ্যৎ কী, কিন্তু এটুকু জানি, প্রথম আলো আমার জীবনের একটা অংশ।
অনুলিখন: শাহ আলম

আরও পড়ুন