বাবা কখনো আমাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেননি
আজ বাবা দিবস। এ উপলক্ষে বাবাকে নিয়ে লিখেছেন প্রথম আলোর পাঠকেরা।
তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। বিজ্ঞান বিভাগে। স্কুল শেষ করেই যেতে হতো প্রাইভেট পড়তে। বাবা ইংরেজির শিক্ষক। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তাঁর কাছে পড়তে বসতে হতো। সব মিলিয়ে ভীষণ ব্যস্ততা। কখনো কখনো পড়তে ইচ্ছা করত না। কিন্তু বাবার মুখের ওপর বলার সাহস হতো না। বাবা বেশ রাগী। বাড়িতে তাঁর মুখের ওপর কেউ কথা বলে না। তাই বলে আমার প্রধান শিক্ষক বাবা কোনো দিন আমার বা বোনের ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেননি। তবে আপত্তি যে করতেন না, তা নয়। মনে আছে, স্কুলে থাকতে বন্ধুদের সঙ্গে একবার কুয়াকাটায় যাওয়ার জন্য অনেক জোরাজুরি ও কান্নাকাটি করেছিলাম। কিন্তু বাবা অনুমতি দেননি। বলেছিলেন, ‘যেতে যে টাকা লাগবে, তার ডাবল নিয়ে রাখো, কিন্তু যেতে পারবা না। পরে আমরা সবাই মিলে যাব।’
ইংরেজির শিক্ষক হওয়ায় সাহিত্যের প্রতি বাবার অনুরাগ আছে। রামায়ণ, মহাভারত, রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল মধুসূদন, শেক্সপিয়ার বাবার সুবাদে স্কুলজীবনেই পেয়েছিলাম হাতে। কারও কারও মুখে শুনেছি, তাঁরা গল্পের বই পড়তেন লুকিয়ে। পড়ার বাইরের বই পড়লে বকা শুনতে হতো। কিন্তু বাবা আমাকে কখনো বই পড়তে নিষেধ করেননি; বরং আরও পড়তে উৎসাহ দিয়েছেন। কোনো কিছু লিখলে, চোখে পড়লে বানান ভুল থাকলে ঠিক করে দিয়েছেন। সাহিত্যের প্রতি আমার যে ভালো লাগা, ইংরেজি যতটা যা শিখেছি, সেখানে বাবার অনেক অবদান।
আমাদের কোনো আবদার বাবা কখনো অপূর্ণ রাখেননি, রাখেন না। কিছু চাইলে যদিও সঙ্গে সঙ্গে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলেন না। কিন্তু সময়মতো তা হাজির হয়ে যায়। তারপরও কারণে–অকারণে ছেলেবেলায় বাবার ওপর অভিমান হতো। স্কুলজীবনে অভিমানের অন্যতম একটা কারণ ছিল বাজারে যাওয়া। ছুটির দিনে বাবার সঙ্গে বাজার করতে যেতে হতো। যেতে না চাইলেও চোখ মোটা করে নিয়ে যেতেন। যদিও বাড়িতে বাবার মতো বাজার করতে পারি না বলে বদনাম আছে আমার। কিন্তু আমি যে বেগুন, পটোল সবজি মোটামুটি দেখে কিনতে পারি, সেই পাঠ বাবাই আমাকে স্কুলজীবনে শিখিয়েছিলেন।
এইচএসসি পরীক্ষা শেষে মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি হলাম। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় দশমিক ২৫ নম্বরের ব্যবধানে সিরিয়াল পিছিয়ে গেল। ভর্তির সুযোগ হলো না। বাবা তাঁর সব সঞ্চয় দিয়ে আমার স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিদ্ধান্তটা নিতে পারিনি। রসায়নে স্নাতক শেষ করেছি। অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে বাড়িতে গেলে বাবা কথায় কথায় বলেছিলেন, ‘অনেক কিছু শেখার কিন্তু বাকি আছে। ছাত্র মনোভাবটা যেন মরে না যায়। নিজেকে ছাত্র ভাবতে পারলে শেখা সহজ হয়। তখন নম্রতা থাকে, বিনয় থাকে; পথ চলাও সহজ হয়ে যায়।’ চলতে ফিরতে রাগে ক্রোধে সব সময় কথাটা মেনে চলার চেষ্টা করি। নিজের যোগ্যতার চেয়ে বেশি কিছু নিতে চাই না। এই বোধও বাবার কাছ থেকেই পেয়েছি। ভীষণ ঝড়ঝাপটার মধ্যেও বাবাকে দৃঢ়তার সঙ্গে অবিচল থাকতে দেখেছি। আমিও সব সময় নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করি। অন্যায়, অবিচার ও শঠতার বিপরীতে দৃঢ়তা ধরে রাখার চেষ্টা করি।
একটা ঘটনা দিয়ে লেখা শেষ করি। কিছুদিন আগে মাস্টার্সের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বাড়িতে গেলাম। বাবা কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘পড়ালেখা আরও একটু বাড়ানোর চেষ্টা করলে হতো না?’ জবাবে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছু বলার আগেই বোন পাশ থেকে বলল, ‘তাহলে বিয়ে কবে করবে?’ বাবা হাসলেন, আমিও হাসলাম। বোনের সঙ্গে বাবার সম্পর্কটাই এমন, বেশ খোলামেলা। জন্মসাল অনুযায়ী আমিও জেন–জির তালিকায় পড়ি। কিন্তু আমি কেন যেন অতটা কাছে যেতে পারিনি। মনে হয়, প্রবল ভালোবাসার মধ্যে কিছুটা দূরত্ব থাকে। অথবা আমরা যাঁরা একটু ‘ব্যাকডেটেড’, তাঁদের সঙ্গে বাবাদের সম্পর্কটাই এমন।
কার্যনির্বাহী সদস্য, বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ