রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়: ছবির মতো ক্যাম্পাস

ক্যাম্পাস আর ক্যাম্পাসের আশপাশই তো তাঁদের ‘পাঠ্য’!
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

হঠাৎ দেখে মনে হতে পারে কোনো পর্যটনকেন্দ্র। তরুণের দলটি বুঝি দূরের কোনো শহর থেকে বেড়াতে এসেছে। আশপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। গাছ, লতা, গুল্ম। পেছনে কাপ্তাই হ্রদের নীল পানি। টংঘরে বসে গল্প করছেন ৮ থেকে ১০ ছাত্রছাত্রী।

এই হলো রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ার চিত্র। যে শিক্ষার্থী দলটির কথা বলছিলাম, তাঁদের অধিকাংশই বন ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগের শিক্ষার্থীরাই বোধ হয় সবচেয়ে ভাগ্যবান। ক্যাম্পাস আর ক্যাম্পাসের আশপাশই তো তাঁদের ‘পাঠ্য’! বিরল, বিপন্ন গাছ, লতা, গুল্ম ইত্যাদি নিয়ে তাঁদের গবেষণা করাটা সহজ হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানগত কারণে। সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিরল উদ্ভিদ নিয়ে এরই মধ্যে বেশ কিছু গবেষণাও করেছে এই বিভাগ।

আবাসিক, একাডেমিক, প্রশাসনিক ভবনের সংকট থাকলেও চোখ জুড়ানো প্রকৃতি অন্যদিক দিয়ে তাদের পুষিয়ে দিয়েছে। বন ও পরিবেশবিজ্ঞান ছাড়াও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও চারটি বিষয়ে পড়ার সুযোগ আছে: কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল, ব্যবস্থাপনা, টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট এবং ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্সেস টেকনোলজি। ৭২৫ শিক্ষার্থী ও ২৮ শিক্ষক মিলে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছোট্ট এক পরিবার।

সবুজের মাঝখানে এই প্রাঙ্গণ
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

যেভাবে শুরু

অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একেবারেই নতুন। ২০০১ সালে ১১টি নতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সেই তালিকায় ছিল রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে।

প্রায় ৬৪ একর জমির ওপর ২০১৬ সালে টিনের ছাউনি দিয়ে অস্থায়ী প্রশাসনিক ও একাডেমি ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। এসব ভবনে ২০১৯ সাল থেকে প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম চলছে। শুরুতে রাঙামাটি শহরের শাহ বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে দুটি রুম ভাড়া করে পাঠদান শুরু হয়েছিল। প্রায় ৫ বছর পর, ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটির ঝগড়াবিল এলাকায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, দীর্ঘদিন পর নিজেদের ক্যাম্পাস পেয়েও খুব বেশি দিন ক্লাস করতে পারেননি শিক্ষার্থীরা। করোনার কারণে ২০২০ সালেও খুব বেশি ক্লাস করা সম্ভব হয়নি। ২০২১ সাল থেকে আবার নিয়মিত ক্লাস শুরু হয়েছে।

পাহাড়ের রাজনীতি ও নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দূরদূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসছেন। কাপ্তাই হ্রদঘেঁষা এই ক্যাম্পাসে গড়ে উঠছে গবেষণার নানা সুযোগ। শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলসহ বেশ কয়েকটি স্থায়ী ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। আগামী বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হলে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম আরও বেগ পাবে বলে মনে করেন উপ-উপচার্য কাঞ্চন চাকমা।

গবেষণা ও উদ্ভাবন

রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এক হয়ে গত দেড় বছরে গবেষণার মাধ্যমে ৫১ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পেয়েছেন। এর মধ্যে বেশ কিছু বিরল প্রজাতির উদ্ভিদও আছে। গবেষণার সুবাদে এগুলো সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

বন ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নিখিল চাকমার নেতৃত্বে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে ২০২১ সাল থেকে। ক্যাম্পাসের আশপাশের বাসিন্দারা বন ও গাছের ওপর কতখানি নির্ভরশীল, সেটিই উঠে এসেছে গবেষণায়। এ ছাড়া বন্য প্রাণী সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব প্রশমন, কার্বন ট্রেডিং (কার্বন নিঃসরণ কমানোর একটা উপায়), পার্বত্য চট্টগ্রামে ঔষধি গাছ নিয়ে গবেষণা করার জন্য কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত অনলাইনে আড্ডা বা সেমিনার আয়োজন করেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁদের বিজ্ঞান ও গবেষণাবিষয়ক আড্ডায় যোগ দিয়েছেন শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ অনেক গুণীজন। বিভাগটি এ বছরই টেকনোলজিক্যাল উৎসবের আয়োজন করেছিল।

রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী উৎপলকান্তি দাশের দুটি গবেষণা স্কোপাস এবং ওয়েব অব সায়েন্স ইন্ডেক্সিং জার্নালে স্থান পেয়েছে। আইইইই, স্প্রিঞ্জার, সিমাগোর মতো নামী সংস্থা বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও তিনি তাঁর গবেষণা উপস্থাপনের সুযোগ পেয়েছেন। প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী রত্না চাকমার দুটি গবেষণাও স্থান পেয়েছে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেল, আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা আলপার ডজার (এডি) সায়েন্টিফিক ইনডেক্স র‌্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বসেরা গবেষকের তালিকায় রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষকের নাম স্থান পেয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষকের পিএইচডি ও দুজন শিক্ষকের এমফিল ডিগ্রি আছে। তিনজন শিক্ষক পিএইচডি অধ্যয়নরত। একজন কর্মকর্তা শিক্ষা ছুটিতে অস্ট্রেলিয়া অ্যাওয়ার্ড স্কলারশিপ নিয়ে স্নাতকোত্তর করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত দুটি ব্যাচ স্নাতক ও একটি ব্যাচ স্নাতকোত্তর শেষ করেছে। ক্যাম্পাসে দুটি একাডেমি ভবন, দুটি প্রশাসনিক ভবন, একটি সেন্ট্রাল লাইব্রেরি এবং একটি ক্যাফেটেরিয়া আছে। কিছু শিক্ষার্থী নিজ উদ্যোগে শহরে ঘরভাড়া করে থাকছেন। তাঁদের যাতায়াতের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বাস আছে।

ক্লাসের পর চলছে গ্রুপস্টাডি
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা যা বলছেন

কথা হলো বন ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী ফারহান সানজিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিকভাবে এমন পরিপূর্ণ ক্যাম্পাস দেশে মনে হয় আর কোথাও পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে আমাদের সাবজেক্টে পড়ার জন্য ক্যাম্পাসটা একদম জুতসই। আমরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক গাছ নিয়ে গবেষণা করতে পারছি।’

কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী পুটপুট্যা ছদক চাকমা বলেন, ‘রাঙামাটি শহরের অস্থায়ী ক্যাম্পাসের তুলনায় এখনকার ক্যাম্পাসের আকাশ-পাতাল তফাত। এখানে মনোরম পরিবেশ ও কাপ্তাই হ্রদের নীল জলের ঢেউ আমাদের মুগ্ধ করেছে। শুধু আবাসন ও একাডেমিক ভবনগুলো নির্মাণ হলে এটা দেশের সেরা ক্যাম্পাস হয়ে উঠবে।’

রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপচার্য কাঞ্চন চাকমা বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পাস এখনো নতুন। তারপরও আমাদের সাত শতাধিক শিক্ষার্থীকে পাঠদানে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে না, প্রশাসনিক কার্যক্রমও ঠিকমতো চলছে। পাঁচটি বিভাগের গবেষণা ও উদ্ভাবনের কার্যক্রমেও যথেষ্ট সাফল্য পাচ্ছি। যদিও আমাদের এখনো বড় ধরনের গবেষণার যন্ত্রপাতি নিতে পারিনি। আশা করছি আগামী দু-এক বছরের মধ্যে সব সংকট নিরসন করা সম্ভব হবে।’