মনে হয়, শর্মিলী ফোন করবে

শর্মিলী আহমেদ।
সংগৃহীত।

তার চলে যাওয়ার পর থেকে কোথায় যেন একটা শূন্যতা অনুভব করেছি। আমি আবার একা হয়ে গেলাম। মনটা এতটা খারাপ যে বোঝাতে পারব না। এখনো প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে ও পরে শুধুই মনে হয় শর্মিলী ফোন করবে। এখনো ফোন বাজলে মনে হয় ওপাশ থেকে শর্মিলী বলবে, ‘বুবু তুমি কী করো, খাইছ; আমি একটু আচার, আর ভর্তা করেছিলাম তোমার জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ দীর্ঘ প্রায় চার যুগের বেশি সময় ধরে জমে থাকা কথাগুলো মনে ভাসছে। মনেই হয় না শর্মিলী নেই।

’৭০ দশকের কথা। কিশোরী শর্মিলীকে তার মা বিটিভি শুটিং সেটে বলছেন, ‘এটা তোমার আরেকটা বোন। ওর নামও লিলি। তোমরা একসঙ্গে থাকবে।’ আমাদের দুজনের ডাকনাম লিলি। সেই যে বুবু ডাকা শুরু করল, তারপর থেকে আমরা হয়ে উঠলাম আত্মার আত্মীয়। শর্মিলী আমাকে শিখিয়ে গেল রক্তের চেয়েও সম্পর্ক আপন হয়।

পরিবারের সঙ্গে শর্মিলী রাজশাহীতে থাকত। সে সময় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার পথচলা। স্কুল, পাড়ায় নানা অনুষ্ঠানে নাচ ও অভিনয় করত। তারপর চলে এল ঢাকায়। পাকিস্তান আমলেই অভিনয় শুরু করে। সে সময় তার পরিচয় হয় রকিবউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে। তিনি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। লেখালেখি করতেন। পাশাপাশি সিনেমাও বানাতেন। তিনি একদিন শর্মিলীকে প্রস্তাব দেন তাঁর সিনেমায় অভিনয়ের। নায়িকা চরিত্রে শুরু হয় চলচ্চিত্রে নতুন করে পদচারণ। একসময় নায়িকা হিসেবে জনপ্রিয় নাম হয়ে ওঠে শর্মিলী আহমেদ। এই নামটাও সিনেমায় এসে হয়। ওর পারিবারিক নাম মাজেদা মল্লিক। শর্মিলীর ছবি ব্যবসাসফলও হলো। রূপালী সৈকতে, আগুন, দহন সিনেমার কারণে দর্শক তাকে চিনতে শুরু করে। সুপারহিট এক নায়িকা শর্মিলী আহমেদকে এবার বিয়ের প্রস্তাব দেন পরিচালক রকিবউদ্দীন। শর্মিলী আর না করতে পারেনি।

স্বামীসহ শর্মিলী রামপুরায় থাকা শুরু করে।

তার সঙ্গে আমার বোনের সম্পর্কের কারণে প্রায়ই শুনতে হয়, সিনেমার জনপ্রিয় নায়িকা শর্মিলী পরবর্তী সময়ে সেভাবে আর সিনেমা করতে পারেননি কেন? অনেকেই তার সম্পর্কে ভুল ধারণাও পোষণ করেন। শর্মিলীকে আমি সুখী মানুষ বলব। সে নিজের মতো করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে। যাকে কখনোই ক্যারিয়ারে কী হলো, সেসব নিয়ে ভাবতে দেখিনি। সত্যি বলতে তাকে ক্যারিয়ারে কখনোই সংগ্রাম করতে হয়নি। অভিনয়ের জন্য কোনো দিন ছুটেও বেড়াননি। কাউকে বলেনওনি অভিনয়ের কথা।

বিয়ের পরে শর্মিলী সংসারকে বড় করে দেখতে থাকে। আগে সংসার, পরে অভিনয়। সন্তান জন্মের পর সে প্রায় একদমই অভিনয় ছেড়ে সন্তানকে সময় দেয়। অভিনয়ের প্রস্তাবগুলোকে সাদরে ‘না’ করে দিতে হয়েছে। সন্তান বড় হওয়ার পরে অভিনয় করলেও ঢাকার বাইরে একসময় যাওয়া বন্ধ করে দেয়।

এমন নয় যে তার শ্বশুরবাড়ির লোক চাইতেন না। দুই পরিবারই ছিল সংস্কৃতিমনা। তারাই কাজ করার শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে। কাজের পরিবেশ পেয়েছে। একই কারণে স্বামী হারানোর পরও সে সাহস হারায়নি। মেয়েকে নিয়ে ভেঙে পড়েনি। সমানতালে চেষ্টা করেছে অভিনয়ে। আর্থিক টানাপোড়েন কখনোই তেমন একটা ছিল না। তারপরও সন্তানকে নিজের মতো করেই বড় করেছে। মেয়েকে মানুষ করতে কাঁধে নিতে হয় নতুন দায়িত্ব। সেখানেও সে সফল।

যেন বোন। দিলারা জামান ও শর্মিলী আহমেদ
ছবি: প্রথম আলো

ক্যারিয়ার নিয়ে তার কখনোই কোনো আফসোস বা অভিমান ছিল না। একজন মা ও একজন অভিনেত্রী হিসেবে সে যে এত দূর এসেছে, এমন একজন মানুষকে আমরা কতটা মূল্যায়ন করতে পেরেছি?

দেশের জনপ্রিয় একজন অভিনেত্রী শর্মিলী। সিনেমা, নাটকে অনেক বাধা পেরিয়ে অভিনয় করে গেছে। বাধাকে সাহস মনে করে এগিয়েছে সে। অনুপ্রেরণা জোগানো এমন মানুষকে দেখলে আমার কষ্ট হতো। মনে হতো শর্মিলীকে সেভাবে মূল্যয়ন করা হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে একনিষ্ঠভাবে সব শ্রম দিয়ে কাজ করে গেছে, তাকে আমরা যতখানি করা দরকার ছিল, ততটা সেভাবে মূল্যয়ন করিনি। এসব নিয়ে শর্মিলী আমাকে কখনোই কিছু বলেনি, কিন্তু ভেবে আমারই খারাপ লাগত। আমরা তো কেউ পুরস্কার বা স্বীকৃতির জন্য কাজ করি না। আমাদের সম্পদ—দর্শকের ভালোবাসা। কিন্তু যখন স্বীকৃতি পাওয়া যায়, তখন কাজের মূল্যায়ন হয়। তার কাছের মানুষ হিসেবে উপলব্ধি করি, শর্মিলীকে জাতীয়ভাবে যদি মূল্যায়ন করা হতো, তাহলে আরও ভালো হতো।

অনুলিখন: মনজুরুল আলম