যত দূরেই থাকি, নটর ডেম চিরকাল ‘আমার’ই থাকবে

নটর ডেম কলেজের ৭৫ বছর পূর্তি উৎসব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

নটর ডেম কলেজে ছিলাম আর কত দিন, দুই বছর! এতগুলো দশক পরও এখনো পুরোটা সময়জুড়ে আছে নটর ডেম। জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধুদের তালিকায় এখনো সেই নটর ডেমিয়ান বন্ধুদেরই নাম।
কিশোরগঞ্জের তৎকালীন কুলিয়ারচর পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছি। ঢাকার নটর ডেম কলেজে উচ্চমাধ্যমিক। তারপর পড়েছি ভারতের নৈনিতালের কুমায়ূন বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অস্ট্রেলিয়ার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতেই বসবাস করছি ২৪ বছর। কিন্তু এখনো নটর ডেমের কিছু পাওয়া গেলে সেটাকেই মনে হয় অনেক আপন। আর কলেজ শেষ হওয়ার পরও নটর ডেমকে ‘আমার’ বলে মনে হয়। আমরা যাঁরা নটর ডেমিয়ান, তাঁদের সবারই বোধ হয় এই প্রবণতা।

অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস শুরুর পর থেকে এখানে একজন দুজন করে নটর ডেমের প্রাক্তনদের সঙ্গে পরিচয় হলেই মনে হতো আপন। যে যেই পেশারই হোক, বাংলাদেশের যে প্রান্তেই আদিবাড়ি হোক, নটর ডেমিয়ানদের মধ্যে খুব সহজেই ভাব হয়ে যেত। সম্পর্ক তৈরি হতো। প্রায় সবারই অধ্যয়নকাল মাত্র দুই বছর হলেও নটর ডেমিয়ানের ছাপ থেকে যায় সারা জীবন।

২০২০ সালে নটর ডেম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফাদার পিশাতোর সঙ্গে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে


২০১৮ সালে নটর ডেম কলেজের গাজী আজমল স্যারের অস্ট্রেলিয়ায় বেড়াতে আসা উপলক্ষে সিডনির প্রাক্তন নটর ডেমিয়ানদের পক্ষ থেকে একটি সম্মাননা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলাম আমরা। একই দিনে অস্ট্রেলিয়ায় প্রথমবারের মতো ছোট্ট পরিসরে হলেও প্রাক্তন নটর ডেমিয়ানদের পুনর্মিলনীও হয়েছিল। এর মধ্য দিয়েই আমরা গড়ে তুলি ‘নটর ডেম কলেজ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন অস্ট্রেলিয়া’। কলেজজীবন পার করে আসার এত দশক পরেও সেই মাত্র দুই বছরের স্মৃতি আগলে অস্ট্রেলিয়াতেই চলে আমাদের আড্ডা।
নটর ডেমকে ঘিরে আমার অনেক অনেক স্মৃতি। মনে পড়ে নটর ডেমের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘আমার সোনালি অতীত’ শিরোনামে একটা লেখা ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাকে। অনেক স্মৃতি নিয়ে লেখা সেই লেখায় ছিল অনেক ছবি। তারপর এই তো সেই ২০২০ সালের আগে ফাদার পিশোতোর সঙ্গে ঢাকার বনশ্রীতে দেখা করেছিলাম, কথা বলেছিলাম দীর্ঘ সময়। প্রচুর ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে পরম মমতায়-স্নেহে সময় দিয়ে কথা বলেছিলেন তিনি।

আমি, আমার ছোট ভাই লিমনসহ পারিবারিকভাবে আমরা চারজন নটর ডেমিয়ান আছি। পরিবার কিংবা ঘরের বাইরে, যেখানেই যাই, জীবনে একটা প্রভাব রেখে যায় নটর ডেম। সেই ৯০ দশকের শুরুতে নটর ডেমে পড়ার সময়ই নির্মল স্যারের নটর ডেমের অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব আর পুরো ক্লাসের বিশাল দলবল নিয়ে গিয়েছিলাম কুলিয়ারচরে, আমাদের বাড়িতে। এরপর বিভিন্ন সময়ে কত নটর ডেমিয়ান যে কুলিয়ারচর ভ্রমণ করেছেন, হিসাব রাখিনি। নটর ডেমের সঙ্গে এতটাই কাছাকাছি সম্পর্ক যে ২০০৬ সালে নিজের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র রেখে গিয়েছিলাম কলেজের রুমে, সত্যি বলতে সেভাবে মুখোমুখি দাওয়াতও করতে পারিনি কোনো শিক্ষককে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে নটর ডেম থেকে ঠিকই নির্মল স্যারসহ আরেকজন ঢাকা থেকে সেই কুলিয়ারচরে এসেছিলেন, আমার বিয়ের আয়োজনে।

১৯৯০ সালে লেখকের বাড়ি কুলিয়ারচরে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে


নটর ডেম থেকে একসঙ্গে পড়াশোনা করে বের হওয়া আমার বন্ধুবান্ধবরা রয়েছে বিভিন্ন উচ্চপদে। জীবনে নানা অবস্থানে তাঁদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার চেয়ে উপস্থিতিই বহু আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। এসব কিছু মিলিয়েই স্মৃতি আর ভালোবাসার একটা বড় জায়গা জুড়ে রয়ে যাবে ‘আমার’ নটর ডেম কলেজ। কিছুদিন আগে কলেজে উদ্‌যাপিত হলো ৭৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। আমার মতো অনেক অভাগাই হয়তো হাজির হতে পারেনি, দূর দেশে বসে আমরা আফসোস করেছি। তবে যত দূরেই থাকি, নটর ডেম কলেজ চিরকাল ‘আমার’ই থাকবে। আমিও থাকব নটর ডেমের হয়ে।

লেখক: সাংবাদিক ও অভিবাসন আইনজীবী, সিডনি