সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একক ভর্তি পরীক্ষা হলে কি ভোগান্তি কমবে

দেশের সব কটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ‘একক’ ভর্তি পরীক্ষা চালুর কথা ভাবছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। যে শিক্ষার্থীরা কয়েক দিন আগেই ‘ভর্তিযুদ্ধ’ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছেন, কিংবা সামনে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন, এই উদ্যোগ সম্পর্কে তাঁদের কী মতামত?

মেয়ে শিক্ষার্থীরা সুফল পাবে

নাদিয়া আক্তার, একাদশ শ্রেণি, সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ, ঢাকা
ছবি: সংগৃহীত

নাদিয়া আক্তার, একাদশ শ্রেণি, সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ, ঢাকা

আমি এখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছি। সামনে ভর্তি পরীক্ষা দেব। যখন ছোট ছিলাম, তখন দেখতাম, যেই বড় ভাইবোনেরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতেন, তাঁরা একরকম হতাশায় ভুগতেন। ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া তো সহজ কথা নয়। আমাদের দেশে এখন ৫৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। একজন শিক্ষার্থী তাঁর পছন্দ অনুযায়ী ক্যাম্পাস বেছে নিতে চাইবেন, একাধিক জায়গায় চেষ্টা করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। তবে সে জন্য একাধিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া কিংবা ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া খুব ক্লান্তিকর ব্যাপার। একক ভর্তি পরীক্ষার যে পদ্ধতি চালুর পরিকল্পনা চলছে, তা অনেকাংশেই শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি লাঘব করবে বলে মনে করি। একক ভর্তি পরীক্ষা হলে একজন ছাত্রী হিসেবে আমিও সুফল পাব। কেননা নানা সামাজিক বাস্তবতায় আমি হয়তো দেশের নানা প্রান্তে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারতাম না, কিন্তু একক ভর্তি পরীক্ষার ফলে আমার সামনে সেই সুযোগ তৈরি হবে। সারা দেশের মেয়ে শিক্ষার্থীরাও এই সুফল পাবে। নীতিনির্ধারকদের অনুরোধ করব, শিক্ষার্থীরা যেন কম খরচে সুযোগটা নিতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।

শিক্ষার্থীদের সুযোগ কমে আসবে

নাফিস আহমেদ, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

নাফিস আহমেদ, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

একটা কথা হয়তো সবাই বলবেন যে একক ভর্তি পরীক্ষার ফলে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ কমাবে। অভিভাবকদের টাকাও বাঁচবে। কিন্তু আমার মনে হয় একক ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের কিছু দুর্ভোগ লাগব হলেও নানা দিক থেকে সুযোগ কমে যাবে। কেননা একক ভর্তি পরীক্ষার ফলে তাঁরা একবারই পরীক্ষা দিতে পারবেন। একটা পরীক্ষার ওপর নির্ভর করেই সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তৈরি হবে—এটা যেমন সত্যি, সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে একটা পরীক্ষায় খারাপ করলেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন আর পূরণ হবে না। অনেকের নির্দিষ্ট কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা থাকে। আলাদা ভর্তি পরীক্ষা হলে প্রশ্নের ধরন বুঝে একটি ‘টার্গেট’ ঠিক করে সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া যায়। কিন্তু একক ভর্তি পরীক্ষায় হয়তো নিজের পছন্দ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ কমে যাবে। নম্বরের ভিত্তিতে একেকজন একেক জায়গায় পড়বে।

গুচ্ছের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে

রাজু আহমেদ, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

রাজু আহমেদ, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সাভারে। প্রথমবার রাজশাহী ও চট্টগ্রাম যেতে হয়েছিল ভর্তি পরীক্ষার জন্য। হুট করে একটা অপরিচিত জায়গায় এক দিন আগে গিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা, সেই কয় দিন খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা হাতে রাখা, এসব সামলানো কিন্তু সহজ নয়। সৌভাগ্যক্রমে ওই বছরই প্রথম গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা শুরু হয়। এই সমস্যার সমাধান হিসেবে আমার মনে হয় গুচ্ছ পদ্ধতি অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। গুচ্ছ পরীক্ষায় ২২টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত থাকায় আমাকে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়নি। এই সুবিধা পেয়েও সমস্যার মুখে পড়েছিলাম ভর্তি প্রক্রিয়ার সময়। একেক বিশ্ববিদ্যালয় একেক সময় তাদের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করায় আমার পছন্দমতো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল আমার প্রথম পছন্দ। কিন্তু বিজ্ঞপ্তি দেরিতে দেওয়ার কারণে আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ভর্তি হই। তার কিছুদিন পর খুলনা বিশ্ববিদ্যায়ের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলে আমি আবার জগন্নাথে ভর্তি বাতিল করে খুলনায় চলে আসি। গুচ্ছ পদ্ধতির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এই ধরনের সমস্যাগুলো দূর করতে পারলে একক ভর্তি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের জন্য ইতিবাচক হতে পারে বলে আমি মনে করি।

আরও পড়ুন

সুপরিকল্পিতভাবে এগোতে হবে

আজমাইন তাসিক, তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

আজমাইন তাসিক, তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশল বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে আপাতদৃষ্টিতে একক ভর্তি পরীক্ষা একটি ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু এটি বাস্তবায়নের আগে কিছু বিষয়ে অবশ্যই বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। এটা অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত। লাখো শিক্ষার্থী, তাঁদের পরিবার, এর সঙ্গে যুক্ত। তাই তাড়াহুড়ো করলে অনেক ঘাটতি থেকে যেতে পারে। বলা হচ্ছে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে একক ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে। সে হিসাবে খুব বেশি সময় নেই। মানবণ্টন, আবেদনের যোগ্যতাসহ অনেক বিষয় নিয়েই সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় সমপর্যায়ের না। এ ক্ষেত্রে একক ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একজন শিক্ষার্থীকে কী কী মানদণ্ডের ভিত্তিতে যাচাই–বাছাই করে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা দেওয়া হবে—এ ব্যাপারে স্বচ্ছ নীতিমালা দরকার। সুপরিকল্পিতভাবে না এগোলে একক ভর্তি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের জন্য বড় ভোগান্তির কারণ হতে পারে।

আরও পড়ুন

ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই আছে

তাহমিনা লোবা, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

তাহমিনা লোবা, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম কেনা, ঘুরে ঘুরে পরীক্ষা দেওয়া—অনেক পরিবারের জন্যই কঠিন। একক ভর্তি পরীক্ষায় একবারই আবেদন করতে হবে, যা একই সঙ্গে সময় ও টাকা বাঁচাবে। নেতিবাচক দিকও আছে। যেমন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্ন তৈরির ধরনে যে স্বকীয়তা বা বৈচিত্র্য আছে, সেটা থাকবে না। সাময়িক ভয় বা অসুস্থতার জন্য কেউ যদি পরীক্ষায় খারাপ করে ফেলে, সে আর দ্বিতীয়বার সুযোগ পাবে না, এটাও একটা চিন্তার বিষয়। তবে একটা ব্যাপারে বিশেষ অনুরোধ করব। একক ভর্তি পরীক্ষাই যদি হয়, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন একসঙ্গে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে। কেউ আগে শুরু করবে, কেউ পিছিয়ে পড়বে, এমন যেন না হয়।