‘সোশ্যাল সায়েন্স কেন? ভালো সাবজেক্ট পাওনি?’

অনেকে ভাবেন, কেবল বিজ্ঞান বা ব্যবসায় শিক্ষাই বুঝি ‘ভালো ছাত্র’র গন্তব্য। সামাজিক বিজ্ঞান (সোশ্যাল সায়েন্স) অনুষদের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে যথাযথ ধারণা না থাকায় অভিভাবকেরা যেমন দ্বিধায় ভোগেন, তেমনি শিক্ষার্থীরাও। আবার চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—এসব নিয়ে তুমুল আলোচনা দ্বিধা বাড়িয়েছে আরও। আদতে সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর সুযোগ-সম্ভাবনা কেমন?

অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, লোকপ্রশাসন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো নানা বিষয় পড়ার সুযোগ আছে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে
কৃতজ্ঞতা: ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

এখন গ্রহণযোগ্যতা আরও বেশি

ইমরান হোসেন ভূঁইয়া, সহকারী অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আধুনিক নগরজীবনের সঙ্গে যুক্ত সব ধরনের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা, উন্নয়ন ও সংশ্লিষ্ট গবেষণার জন্যই সামাজিক বিজ্ঞানের গ্রহণযোগ্যতা এখন আরও বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যাঁরা মানবিক বিভাগ নিয়ে পড়েছেন, তাঁরা তো বটেই, এর বাইরেও যাঁরা বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগ থেকে এসে বিষয় পরিবর্তনের কথা ভাবছেন তাঁরাও, সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো বেছে নিতে পারেন। যাঁরা প্রথাগত ও ঐতিহ্যবাহী বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনা করতে চান, তাঁদের জন্য এখানে আছে অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, লোকপ্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়। আর যাঁরা আন্তর্জাতিক চাহিদা ও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চ্যালেঞ্জিং ও প্রায়োগিক বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে চান, তাঁরা পড়তে পারেন উন্নয়ন অধ্যয়ন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, জনসংখ্যা বিজ্ঞান, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন, অপরাধবিজ্ঞান, জাপানিজ স্টাডিজ, যোগাযোগ বৈকল্য এবং টেলিভিশন চলচ্চিত্র ও ফটোগ্রাফির মতো বিষয়।

বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সামাজিক বিজ্ঞানে স্নাতকদের জন্য সুখবর হলো—বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর পর বিশ্বব্যাপী সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে মাস্টার্স ও পিএইচডির ক্ষেত্রে বৃত্তির সুযোগ সবচেয়ে বেশি। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতকোত্তর করা যায়। রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক—দুই ধরনেরই প্রচুর বৃত্তি আছে।

অনেকেই এই অনুষদে পড়তে চান

আবদুল্লাহ-আল-মামুন, চেয়ারম্যান, জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকে সামাজিক বিজ্ঞান সম্পর্কে আমরা খুব একটা জানার সুযোগ পাই না। ছেলেমেয়েদের জানা-বোঝার মধ্যে থাকে কেবল বিশাল একটা ভবন। ভবন বলছি, কারণ, বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের নামে আলাদা ভবন চোখে পড়ে।

ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের হার দেখে কিন্তু বোঝা যায়, অনেক শিক্ষার্থী এই অনুষদের নানা বিষয়ে পড়তে চান। অর্থনীতি, নৃবিজ্ঞান, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন, উন্নয়ন অধ্যয়ন, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও ফটোগ্রাফি প্রভৃতি বিষয়গুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে ভর্তির সুযোগ আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও এই অনুষদভুক্ত বিষয়ে পড়া যায়। এসব বিষয়ে মানবসমাজের নানা দিক বৈজ্ঞানিকভাবে গবেষণার পাশাপাশি তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়।

এখনকার সময়ে কিছু কিছু শব্দ আমরা খুব শুনতে পাই। যেমন আবেগপ্রবণ বুদ্ধিমত্তা (ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স), যোগাযোগ দক্ষতা, আলোচনার দক্ষতা (নেগোসিয়েশন স্কিল) ইত্যাদি। সামাজিক বিজ্ঞানে পড়েই কিন্তু এসবের ধারণা পাওয়া যায়। এ ছাড়া প্রচুর বইপড়া, হাতে কলমে কাজ ও গবেষণা, শিক্ষাসফর, মুক্ত পেশাজীবী হিসেবে গবেষক বা অনুবাদক হিসেবে কাজের সুযোগ—এসবও সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে খুব পরিচিত।

আরও পড়ুন

গবেষণার সুযোগ আছে

নাফিসা নাজীন, প্রভাষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে আমরা সাধারণত অর্থনীতি, নৃবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কিংবা উন্নয়ন অধ্যয়নের মতো বিষয়গুলো পড়ার সুযোগ পাই। বিজ্ঞান আর ব্যবসার জনপ্রিয়তায় ভুলে গেলে চলবে না—মানুষ হিসেবে আমরা কিন্তু সামাজিক প্রাণী। প্রযুক্তি, ব্যবসার দুনিয়ায় যত পরিবর্তনই আসুক, এই সত্যটা হারিয়ে যাবে না।

তাই সমাজ নিয়ে বিশ্লেষণ, গবেষণার সুযোগ থাকবে সব সময়। বিভিন্ন আঙ্গিকে গবেষণার মাধ্যমে মানবজীবন ও সামাজিক জীবনের বিষয়গুলোই সমাজবিজ্ঞানের একেকটি শাখায় উঠে আসে। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম চোখে পড়ে। তথ্যের অভাব, পারিপার্শ্বিক চাপ তো আছেই, সীমাবদ্ধ সুযোগের কারণেও দেশে অনেকে সমাজবিজ্ঞানে পড়তে চান না।

অথচ প্রযুক্তি কিংবা বিজ্ঞানের বিকাশের কারণে কিন্তু সমাজবিজ্ঞানেও নতুন অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে। আপনার পড়ার বিষয় যা-ই হোক, আপনি যদি আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে হালনাগাদ রাখতে পারেন, তাহলে আপনার অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার ভয় থাকবে না কখনোই। সামাজিক বিজ্ঞানে গবেষণার সুযোগ অনেক। আর সে কারণেই আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থী বিএসএস (ব্যাচেলর অব সোশ্যাল সায়েন্স) ডিগ্রি নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে যাচ্ছে। যারা এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে, তারা এসব সুযোগ সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে পার।

আরও পড়ুন

বিজ্ঞান, ব্যবসায় পড়েও অনেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করছে

বায়েজীদ খান, সহকারী অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিষয়গুলোতে সাধারণত সমাজের সমস্যা, সংকট, সমাধান ও সম্ভাবনার দিকগুলো পড়ানো হয়। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন বা প্রকৌশল-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো যেমন ল্যাবনির্ভর, তেমনি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিষয়গুলোও কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণানির্ভর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা ল্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে এ-সংক্রান্ত গবেষণা করা হয়।

আমাদের দেশে ধীরে ধীরে বুদ্ধিভিত্তিক কাজ ও পেশার বিস্তৃতি ঘটছে। দেশি-বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠানই সামাজিক বিজ্ঞানে পড়া ছেলেমেয়েদের নিয়োগ দিচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগসহ (সিপিডি) জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, উন্নয়ন অধ্যয়নের শিক্ষার্থীদের চাহিদা বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকেই ছেলেমেয়েরা ইন্টার্নশিপেও যুক্ত হচ্ছে। খেয়াল করে দেখবেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই এখন সামাজিক বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে স্নাতকোত্তর চালু করেছে। বিজ্ঞান এবং ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীরাও কিন্তু এসব স্নাতকোত্তর কোর্সে ব্যাপক হারে ভর্তি হচ্ছে। পেশার ক্ষেত্রে চাহিদা বেড়েছে বলেই স্নাতকোত্তর কোর্সগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে।