স্টার্টআপ চালু করে কীভাবে আমেরিকার ভিসা পেতে পারেন সে বিষয়ে বই লিখেছেন তাহমিনা

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তাহমিনা ওয়াটসন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসনবিষয়ক আইনজীবী। পেশাগত কাজের পাশাপাশি দেশটির অভিবাসন আইনের সংস্কার নিয়েও তিনি সোচ্চার। তাঁর লেখা এ-সংক্রান্ত কয়েকটি বই পাঠকপ্রিয় হয়েছে। সম্প্রতি দেশে এলে তাহমিনার সঙ্গে দেখা করেন সুরাইয়া সরওয়ার

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তাহমিনা ওয়াটসন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসনবিষয়ক আইনজীবীছবি: সুমন ইউসুফ

তাহমিনা ওয়াটসনের ম্লান হাসির মধ্যেই যেন ফুটে উঠল মা হারানোর শোক। মাতৃবিয়োগের খবর পেয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন গত ১৫ এপ্রিল। যশোরে মাকে শেষবিদায় জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার আগে উত্তরায় একটি হোটেলে তাহমিনার মুখোমুখি হই আমরা।

অভিবাসনবিষয়ক আইনজীবী হয়ে ওঠার গল্প দিয়েই আলাপ শুরু করেন তাহমিনা। সেই আলাপেও ঘুরেফিরে আসে প্রয়াত মায়ের কথা। বললেন, ‘আমার মায়ের নাম হোসনে জাহান মোল্লা। সব সময় চাইতেন, আমি যেন আইনজীবী হই। ভাবতে ভালো লাগছে যে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি।’

যুক্তরাজ্যে জন্ম হলেও শৈশব-কৈশোরের বড় একটা সময় বাংলাদেশে কাটিয়েছেন তাহমিনা। ১৯৮৩ সাল, তখন তাঁর বয়স আট বছর। যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে আসে তাহমিনার পরিবার। তাঁকে ভর্তি করানো হয় দাদাবাড়ি বাগেরহাটের আদর্শ শিশু বিদ্যালয়ে। স্কুলজীবনে খুব ডানপিটে তাহমিনার মফস্‌সল শহরের সেই স্মৃতিগুলো আজও অটুট।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনের প্রচারণায় অভিবাসনসংক্রান্ত দলের সদস্য ছিলেন তাহমিনা
ছবি: সংগৃহীত

বাগেরহাট থেকে তাহমিনারা চলে আসেন ঢাকায়। মধুবাগের শের-ই-বাংলা হাইস্কুলে ভর্তি হন তাহমিনা। এই স্কুল থেকেই এসএসসি। সেই স্মৃতিচারণা করছিলেন তাহমিনা, ‘ধরেই নিয়েছিলাম, স্ট্যান্ড করব। দারুণ পরীক্ষা দিয়েছিলাম। রেজাল্ট ঘোষণার দিন রেডিও খুলে বসে ছিলাম। কিন্তু রেডিওতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীর নাম বলা হলো, কিন্তু তাতে আমি নেই! দরজা বন্ধ করে খুব কাঁদলাম।’

তাহমিনা যখন রুমের দরজা বন্ধ করে কাঁদছিলেন, দূরে তখন প্রতিবেশীদের কোলাহল শোনা যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে সেই হল্লা তাঁদের বাড়িতেই চলে এল। তাহমিনা বলেন, ‘সবাই এসে বলতে লাগল, “পিংকি (আমার ডাকনাম) স্ট্যান্ড করেছে! পিংকি স্ট্যান্ড করেছে!” পরে জানলাম, আমি ঢাকা বোর্ডে সপ্তম স্থান অধিকার করেছি। আর মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ।’

এসএসসির পর আবার যুক্তরাজ্যে ফিরে যান তাহমিনা। তাঁর বাবা ছিলেন আইনজীবী। তিনিও লন্ডনের ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়া শুরু করেন। ব্যারিস্টার হওয়ার পর যুক্তরাজ্যেই আইন পেশা শুরু করেন। ২০০৫ সালে স্বামী টম ওয়াটসনের সঙ্গে লন্ডন ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ২০০৯ সালে সিয়াটলে প্রতিষ্ঠা করেন আইনি প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াটসন ইমিগ্রেশন ল’। অভিবাসন আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে নিউইয়র্ক টাইমস, ব্লুমবার্গ, সিএনএনসহ বিশ্বখ্যাত সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই তাঁর নিবন্ধ ও মন্তব্য প্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনের প্রচারণায় অভিবাসনসংক্রান্ত দলের সদস্য ছিলেন তিনি।

যেখানেই কোনো কাজে যান, তাহমিনার সঙ্গে থাকে ক্যামেরা
ছবি: সংগৃহীত

বই, পাখি আর ধ্যান

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর নাগরিকত্বের আবেদন করেন তাহমিনা। সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে তাঁকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। একজন আইনজীবী হয়েও পদে পদে যে সমস্যার মুখোমুখি হন, তা তাহমিনাকে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। তার পর থেকে শুধু আইনজীবী হিসেবেই নয়, নিজের আগ্রহ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন আইনের সংস্কার নিয়ে জোরালো প্রচারণা চালাচ্ছেন।

২০০৮ সালে নিজের পেশাগত অভিজ্ঞতা নিয়ে ব্লগ লেখা শুরু করেন তাহমিনা। অনেকেই তাঁর ব্লগ পড়তেন। যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আইনে যেসব পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, তা নিয়েও লিখতেন। ব্লগের পাশাপাশি এরপর পত্রিকাতেও লেখা শুরু করেন। এভাবেই তাঁর লেখকজীবনের শুরু। অভিবাসনবিষয়ক জটিল আইন সহজভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে তাঁর বইগুলো। সর্বশেষ বইটি উদ্যোক্তাদের স্টার্টআপ চালু করে কীভাবে আমেরিকার ভিসা পেতে পারেন সে বিষয়ে। নতুন এই বইয়ের নাম দ্য স্টার্টআপ ভিসা: ইউএস ইমিগ্রেশন ভিসা গাইড ফর স্টার্টআপস অ্যান্ড ফাউন্ডারস। ভিসা কী, কোন ভিসার জন্য কী কী যোগ্যতা লাগে, কার কোন ভিসার জন্য আবেদন করা উচিত, এই বইয়ে রয়েছে এসব প্রশ্নের উত্তর।

নিজের বই হাতে তাহমিনা ওয়াটসন
ছবি: সুমন ইউসুফ

জটিল আইনি দুনিয়ার মানুষ হলেও তাহমিনা মনে করেন, সবকিছুর আগে নিজেকে সময় দেওয়া জরুরি। তিনি প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে সূর্যোদয় দেখেন, পাখি দেখেন আর পাখিদের ছবি তোলেন। তিনি মনে করেন, ওই সময়ে কেউ তাঁকে বিরক্ত করতে পারবেন না, কারও তখন তাঁকে দরকার নেই। এ ছাড়া কয়েক বছর ধরে নিয়মিত ধ্যান করছেন তিনি। তাহমিনা বলেন, ‘বেশির ভাগ সময়ই দেখি, আমার ক্লায়েন্টরা খুব চিন্তিত কিংবা অবসন্ন। তাঁদের সাহায্য করার জন্য আমার নিজেকে স্থির রাখা সবচেয়ে বেশি জরুরি। ধ্যান আমাকে ধীরস্থির থাকতে সাহায্য করে। এখন তো আমি মেডিটেশনের সেশনও নিই, কোভিডের সময় আমি শিশুদের মেডিটেশনের ক্লাস নিয়েছি।’

ভোরের পাখিদের ছবি তুলতে তুলতে ছবি তোলাটাও বেশ রপ্ত করেছেন। শখের বশেই ছবি তোলা শুরু। যে পাখির ডানাটা কিংবা লেজটা একটু সুন্দর লাগত, সেটারই ছবি তুলে রাখতেন। মুঠোফোন দিয়েই ছবি তোলা শুরু, এরপর ছোট্ট একটা ডিজিটাল ক্যামেরা। তারপর তাঁর ক্যামেরার আকার বাড়তে থাকে। এখন যেখানেই কোনো কাজে যান, সঙ্গে থাকে ক্যামেরা। অনেক সময় আবার ছবি তোলার জন্যই রোড ট্রিপে বেরিয়ে পড়েন। পাখির ছবি দিয়ে শুরু করলেও এখন যেকোনো জীবজন্তুর ছবিই তোলেন। নিজের তোলা ছবিগুলো সাজিয়ে রেখেছেন তাঁর ওয়েবসাইটে।

বললেন, ‘এবার তো দেশে হুট করে আসা হয়েছে, আবার সময় নিয়ে দেশে এসে পাখির ছবি তুলব।’