৩২ বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলা যেভাবে জমে উঠল

শুধু আনন্দের জন্য খেলা নয়, হয়েছে তুমুল প্রতিযোগিতা
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

সাভারের বিরুলিয়ায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির খেলার মাঠটা প্রথম দেখায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। এই মাঠেই হয়ে গেল ইস্পাহানি-প্রথম আলো আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টের মহাযজ্ঞ, যার মেয়াদকাল গত ১৮-৩০ জুলাই। ১৪-১৫ জুলাই চট্টগ্রাম এবং ১৬ জুলাই কুমিল্লা অঞ্চলে খেলা শেষে ৩২ দলের এ আয়োজন গড়ায় ঢাকায়। আর ঢাকা পর্বের পুরোটাই হলো জমজমাট ও আকর্ষণীয়।

সকাল থেকে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনটি ম্যাচ, কোনো কোনো দিন চারটিও হয়েছে। তীব্র রোদের মধ্যে মাঠের লড়াইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্সি গায়ে ছাত্রদের সে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা! নিজ নিজ দলকে জেতাতে হবে। টুর্নামেন্ট নকআউট হওয়ায় না জিতলেই যে বাদ!

তাই সেরা শক্তি নিয়ে দলগুলো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক টুর্নামেন্টে সাধারণত জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের সেভাবে পাওয়া যায় না। কিন্তু ইস্পাহানি-প্রথম আলো টুর্নামেন্টে অনেকে খেলেছেন। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি দলের জার্সিতে গোটা আয়োজনে রং ছড়ান জাতীয় দলের ডিফেন্ডার রহমত মিয়া, ফরোয়ার্ড ফয়সাল আহমেদ ফাহিম, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির হয়ে মিডফিল্ডার মোহাম্মদ হৃদয়। টুর্নামেন্টটাও তাই পেয়েছে ভিন্নমাত্রা। দেশের শীর্ষ ফুটবল প্রিমিয়ার লিগের ৯ জন খেলেছেন রানার্সআপ ফারইস্টে। চ্যাম্পিয়ন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ ফুটবলারই পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তরে খেলেন। তবে তাঁদের যোগ্যতা আছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে খেলার। অন্য দু–তিনটি দলেও ছিলেন শীর্ষ স্তরে খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ফুটবলার। টুর্নামেন্টটি তাই ‘শুধু আনন্দে খেলা’ পর্যায়ে আর সীমাবদ্ধ থাকেনি। জমে উঠেছে তুমুল প্রতিযোগিতা।

বেশির ভাগ ম্যাচে দারুণ লড়াই হয়েছে। খেলার মানও ছিল বেশ ভালো। মাঠে উপস্থিত থেকে ঢাকা পর্বের সব কটি খেলা দেখার অভিজ্ঞতায় বলতে দ্বিধা নেই, কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় দল অনায়াসে দেশের দ্বিতীয় সারির কোনো ক্লাবের সঙ্গে লড়তে পারে। একটা ‘ফুটবল বাহিনী’ হিসেবে তৈরি হয়ে গেছে গণ বিশ্ববিদ্যালয় বা ফারইস্টের মতো দলগুলো। তারা আনন্দ দিয়েছে দর্শকদের। ফলে কয়েকটা দিন কেটেছে ফুটবলানন্দে। তীব্র রোদ আর গরমে হাঁসফাঁস অবস্থাও বাধা হতে পারেনি তাতে।

চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে দর্শকের একাংশ
ছবি: জুয়েল শীল

ফাইনালটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে বহুদিন। ফারইস্ট বনাম গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধুন্ধুমার লড়াই ৩০ জুলাই দিনটাকে রেখেছে আলাদা করে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ফুটবলে এই দুই দলের মধ্যেই ভাগাভাগি হয় বেশির ভাগ ট্রফি। ফারাজ গোল্ডকাপ বা অন্য টুর্নামেন্টে সেটা দেখা গেছে। দুই দল মুখোমুখি হলে মনে হয়, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বা আমাদের এককালের আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথ! ফাইনালে ৭০ মিনিটের নির্ধারিত সময়ে গোল নেই। এরপর সরাসরি টাইব্রেকারের ভাগ্যপরীক্ষা। টাইব্রেকারের সময় মাঠের দৃশ্যটা বাঁধাই করে রাখার মতো। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ইস্পাহানি গ্রুপের পরিচালক ইমাদ ইস্পাহানি পর্যন্ত আসন ছেড়ে মাঠের পাশে এসে দাঁড়ান টাইব্রেকার দেখতে।

দেশসেরা সাবেক ফুটবলার এবং টুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান গোলাম সারোয়ার টিপু, টুর্নামেন্ট কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ সুলতান জনি, শফিকুল ইসলাম মানিক, আলফাজ আহমেদ, টুর্নামেন্টের টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নুসহ অন্যরা ফাইনালেও এসেছেন। তাঁরাও টাইব্রেকার-উত্তাপের মধ্যে হারিয়ে যান দর্শকের ভিড়ে। কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রীকে রোমাঞ্চে ডুবিয়ে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে জিতে টুর্নামেন্টের প্রথম শিরোপা ঘরে তোলার পাশাপাশি গণ বিশ্ববিদ্যালয় জিতে নিয়েছে ৫ লাখ টাকাও। শেষ বাঁশির সঙ্গে সঙ্গে চ্যাম্পিয়নদের হাজার সমর্থকের উল্লাস যেন থামছিলই না।

এই টুর্নামেন্ট তারুণ্যের আবাহন হয়ে স্বপ্ন এঁকেছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের মধ্যে। এদের অধিকাংশই কিন্তু পেশাদার ফুটবলার নন। কিন্তু তাঁদের মধ্যেও বেশ কয়েকজন আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিফেন্ডার বিশাল, রাইট উইঙ্গার সজলের কথা বলা যায় আলাদাভাবে। এমন আরও কয়েকজন শীর্ষ স্তরে খেলার যোগ্যতা রাখেন।

নিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে জেতাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন খেলোয়াড়েরা
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

একেকটি ম্যাচ শেষে সেরার পুরস্কার তুলে দিয়ে গিয়ে সাবেক তারকা ফুটবলাররা নিজেদের উচ্ছ্বাস চেপে রাখেননি। চুন্নু যেমন বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা শুধু পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকে না সারা বছর, খেলায়ও ওরা পাকা। এটা বোঝা গেছে এই টুর্নামেন্টে।’

মাঠের খেলায় লড়াই যতই হোক, মাঠের বাইরে ছিল ষোলো আনা সৌহার্দ্য। পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র একজন খেলোয়াড়ের লাল কার্ড পাওয়ার ঘটনা যার বড় উদাহরণ। খেলা পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের অধীনে থাকা সাবেক ফিফা রেফারি জালাল উদ্দিন, মাহমুদ জামাল ফারুকিসহ অন্যরা। ছিলেন বর্তমান সময়ের সেরা রেফারিরাও। ম্যাচ কমিশনার হিসেবে সাবেক ফিফা রেফারি, বাফুফের হেড অব রেফারি আজাদ রহমানের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণের কথাও না বললেই নয়। রেফারির সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠে হয়নি কোনো বিতর্ক। খেলোয়াড়দের নিয়েও আসেনি কোনো অভিযোগ।

যে দলগুলো ভালো করতে পারেনি, ভবিষ্যতে শক্তিশালী দল নিয়ে ফেরার প্রত্যয় জানিয়ে গেছে তারা। এটাই এই টুর্নামেন্টের বড় সার্থকতা।

সাবিরা সুলতানা যখন কোচ

৩২ মিনিটের জন্য দলের ভারপ্রাপ্ত কোচ হিসেবে ডাগআউটে দাঁড়াতে হয় সাবিরাকে
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

দেশসেরা ভারোত্তোলক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন অনেক আগেই। দেশি-বিদেশি পদক জিতেছেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে হয়ে গেলেন ফুটবল কোচ! মোল্লা সাবিরা সুলতানার জীবনে ২০ জুলাই দিনটি ভোলার নয়। ইস্পাহানি-প্রথম আলোর টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বিপক্ষে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাচে রেফারির সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে লাল কার্ড দেখেন শেরেবাংলার কোচ ও প্রতিষ্ঠানটির শারীরিক শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। তাঁর জায়গায় ৩২ মিনিটের জন্য দলের ভারপ্রাপ্ত কোচ হিসেবে ডাগআউটে দাঁড়াতে হয় সাবিরাকে। সময়টা তিনি উপভোগই করেছেন। আর নিয়েছেন জীবনে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। তাই তো মজা করে বলেন, ‘কখনো ভাবিনি এভাবে ফুটবল কোচ হয়ে যাব! ঘটনাচক্রে হয়ে গেছি। অন্য রকম একটা ব্যাপার (হাসি)। কখনো দিনটা ভুলব না।’