ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মেয়েটির সঙ্গে দেখা

ভালোবাসার গল্প আহ্বান করেছিল ‘ছুটির দিনে’। বিপুল সাড়া দিয়েছেন পাঠকেরা। কেউ লিখেছেন দুরন্ত প্রেমের গল্প, কেউবা শুনিয়েছেন দূর থেকে ভালোবেসে যাওয়ার অনুভূতি। এখানে পড়ুন বাছাই একটি লেখা।

অপারেশনের ডেট পেতে আরও এক মাস। জন্মের মুহূর্ত থেকেই হৃদ্‌যন্ত্রে গোলমাল। তাকে মেরামত করতে হবে। এ জন্য আত্মীয়স্বজনের সব মায়া-মমতা পেছনে ফেলে হাজার মাইল দূরে ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অপারেশনের ডেটের আগে বেড পাওয়াটা বেশি জরুরি। বেড পেলে অপারেশনের ডেটটাও মিলবে। তাতে হাসপাতালের পাশে লজে শুয়ে বাড়তি টাকা গুনতে হবে না।

দুই মাসের প্রতীক্ষার পর অবশেষে একটা বেড পাওয়া গেল। তবে সাধারণ ওয়ার্ডে নয়, সেমি-আইসিইউ। অর্থাৎ, আধা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের একটি বেড। অন্তত পনেরোটি বেডের বিরাট ইউনিট। কম জটিল হৃদ্‌রোগী অথবা ফুসফুসের রোগীদের অপারেশনের পর এই সেমি-আইসিইউতে নিয়ে আসা হয়। অনেক হাপিত্যেশের পর এই বিশাল ওয়ার্ডে একটা বেড জুটল চাঁদের। মূল দরজার পাশেই। ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়রা আসছে-যাচ্ছে। তার ওপর অপারেশন হয়ে যাওয়া রোগীদের কাতরানি। এমনিতে শান্ত পরিবেশ না হলে চাঁদের ঘুম আসে না। বিছানা বদল হলে তো কথাই নেই। তার সঙ্গে যদি হয় মানুষের জীবন-মৃত্যুর আর্ত যন্ত্রণা।

একটুখানি চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে, ‘হামকোতো ছুট্টি মিলা। হাম চলতে রাহে। আপ খুশ রহে...।’

বিকেলবেলা লজে চা খেয়ে বেডে এসেছে চাঁদ। সেমি-আইসিইউ’র এই হট্টগোল প্রথম থেকেই তার পছন্দ হচ্ছিল না। এর মধ্যে রাতের খাবার এসে গেছে। হাসপাতালের নিয়ম। ছ’টা সাড়ে ছ’টার মধ্যে রাতের খাবার সেরে নিতে হবে। তারপরে বিশ্রাম আর ঘুম। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। আটটা নয়টা দশটা এগারোটা বারোটা। চাঁদের চোখে একফোঁটা ঘুম নেই। চোখের পাতা একটু লেগে আসছে তো কোনো রোগীর কাতরানোর শব্দ। অতএব জানালা গলিয়ে আকাশের তারা গোনা ছাড়া উপায় কী! বেডে এপাশ-ওপাশ করতে করতেই একসময় চাঁদের চোখ আটকে যায় দূরের কোনার বেডের এক সদ্য তরুণীর চোখে। কী আশ্চর্য! মেয়েটি যে তার দিকেই অপলক তাকিয়ে আছে। সকালবেলায়ই ওর ফুসফুসে অপারেশন হয়েছে। তারপর কেটে গেছে ১২ ঘণ্টা, কিন্তু যন্ত্রণা ও অস্বস্তি পুরোপুরি কমেনি। তারপরও যখনই একটু ভালো লাগছে, চোখের দৃষ্টিটাকে ফিরিয়ে আনছে পঁচিশ বছরের যুবক, কিন্তু কিঞ্চিৎ বালকোচিত চেহারার চাঁদের দিকেই। ঘুমের একটু চেষ্টা করেও কিছু পরে চাঁদ একটু আড়চোখে তাকিয়ে দেখে শারীরিক ক্লিষ্টতার মধ্যেও মেয়েটি তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে। এ কি ভালো লাগা, নাকি এক রোগীর প্রতি আরেক রোগীর সহমর্মিতা! চাঁদ ভাবতে পারছে না। তারপরও দেখতে কেন জানি ভালো লাগছে। শ্যামবর্ণা কিন্তু অসাধারণ মুখশ্রী, স্মিত হাস্যে ধবধবে সাদা দন্তপাটি, শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা টিকোলো নাক আর মাথায় একরাশ আধকোঁকড়া কালো চুল; ভালো সময় নিশ্চয়ই খোঁপায় বেলি ফুলের মালা পরে। খুব বড়সড় নয়, তবে দেহের গড়নটা বলে দেয় তামিলটামিল হবে। যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরখানা থেমে থেমে বেঁকে উঠছে, কিন্তু একটু সুস্থির হলেই মুখটা যেন মেঘের কিঞ্চিৎ আড়ালে ঢাকা একরাশ চাঁদের আলো।

চাঁদের চোখে এখন আর ঘুম নেই। মেয়েটাকে সে দেখছে। বেডে এপাশ-ওপাশ করে মেয়েটাও তাকে দেখছে। তারপর শুরু হয় যেন বিনিসুতার মালায় না বলা কথার মালা গাঁথা। দুজনের মুখেই কোনো কথা নেই অথচ কত কথা, এ যেন জন্ম-জন্মান্তরের কথা। হাজার হাজার কথার অশ্রুত কথা। না বলেও মানুষ কী এভাবে কথা বলে! এখন আর ঘুমের যন্ত্রণা নেই চাঁদের। আরও ক’ঘণ্টা কেটে গিয়ে আকাশ ফরসা হতে শুরু করে। আশপাশে অনেকেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পাখপাখালির মৃদু কোলাহল। একটা সৌম্য পরিবেশ। আর তা দুজনের চোখেই ঘুমের মায়াবী অঞ্জন বুলিয়ে দেয়।

ঘণ্টা তিনেক পর আটটা বাজতেই চারপাশের কোলাহল দুজনেরই মধুর ঘুম ভেঙে যায়; নার্স ও ওয়ার্ডবয়দের পদচারণ, ডাক্তারদের ভিজিট শুরু হয়েছে। বেলা আরেকটু গড়াতেই বড় ওয়ার্ডটির উল্টো পাশে একটু ভালো জায়গায় চাঁদের আরেকটি বেড মিলল। এরই মধ্যে এ ওয়ার্ড থেকে দু-একজন চলে গেল অন্য ওয়ার্ডে। কাউকে নেওয়া হলো অপারেশনের থিয়েটারে। আরে এ কি! ওই মেয়েটাও যে চলে যাচ্ছে। হুইলচেয়ারে বসা, এই স্নিগ্ধ সকালে সে অনেকটাই শান্ত সমাহিত। কিন্তু মেয়েটার চোখ যেন বলছে ‘কেন যাচ্ছি এ ওয়ার্ড ছেড়ে?’ তার নিষ্পলক দৃষ্টি চাঁদের মুখের ওপর। হুইলচেয়ারটি দরজা প্রায় পেরোতেই চাঁদের মুখ থেকে খসে পড়া একটা অস্ফুট কথা যেন বলতে চায়, ‘কে গো তুমি, এলে আমার খুঁতে ভরা হৃদকমলে কাঁটার ক্ষত তুলতে?’

মাঝখানে কয় দিন চলে গেছে, চাঁদের দুটো চোখ ঘুরে ফেরে খোঁজে সেই মেয়েটির মুখ। খোঁড়া হৃদ্‌যন্ত্র তোলপাড় করে, পাশের বেডের দিদি গোছের এক রোগী কী চাঁদের মনটাকে ধরতে পারল? সুমিতাদি এসে বললেন, ওই মেয়েটির নাম রানী, বছর ষোলো বয়েস। ভারতের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের কন্যাকুমারীতে বাড়ি। ও ভালো হয়ে গেছে। আজকেই বাড়ি চলে যাবে। চাঁদ যেন খানখান হয়ে ভেঙে পড়ে সমুদ্রে। তৈরি হয় উথালপাথাল। এ কি হলো? দ্রুততর হয় দুর্বল হৃদ্‌যন্ত্রে বিট। মনের কোণে একটা জোর এনে তাই চাঁদ অস্ফুটে বলে, ‘না, না। আমি তো হার্টে অপারেশন করাতে এসেছি। আমার হার্ট তো কাউকে দিতে আসিনি।’

সেদিন বেলা প্রায় একটা। বেডের মধ্যেই একটা টুলের আসন পেতে দুপুরের খাবারের আয়োজন করছেন চাঁদের মা। হঠাৎ কোত্থেকে সুমিতাদি সেই মেয়েটিকে নিয়ে এসে হাজির। শরীরে মেয়েটির যন্ত্রণার লেশমাত্র নেই। বরং মুখে অসাধারণ স্নিগ্ধ হাসি। মাথায় বেলি ফুলের স্নিগ্ধ গন্ধ। ও কি বুঝতে পেরেছে, বেলি ফুল ভালোবাসে চাঁদ? হাত দুটো জোড় করে বুকের কাছে ঠেকিয়ে প্রণামের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে খুবই মিষ্টি গলায় শুধায়, ‘অপারেশনকা ডেট মিলা?’ চাঁদ ওর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে হতাশ গলায় বলে, ‘নেহি মিলা’। রানী যেন একটু হোঁচট খায়। যেন বলতে চায়, ‘আমি ভালো হয়ে গেছি, তুমিও ভালো হয়ে যাও।’একটুখানি চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে, ‘হামকোতো ছুট্টি মিলা। হাম চলতে রাহে। আপ খুশ রহে...।’

এক পা-দু’পা করে রানীর অবয়বটি অপসৃত হয়ে যায়। খাবার সামনে রেখে চাঁদ স্থবির হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। সংবিৎ ফিরে এলে কানে সেই জিজ্ঞাসাটা বাজতে থাকে ‘অপারেশনকা ডেট মিলা...আপ খুশ রহে।’

চাঁদ কি খুশি থাকতে পেরেছে? পঁচিশটি বছর ধরে সে তো শুধু ঢাকা পড়ে আছে মেঘের আড়ালে!