১৯৪৩ সালের এই কাবিননামায় কী আছে

কাবিননামার সিলমোহর
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

মুঠোফোনের ওপাশে ছোট ভাই ইমনের উত্তেজিত গলা, ‘আপা তোর জন্য একটি উপহার আছে, আজই বাসায় আয়।’ কী এমন উপহার যে এখনই আসতে হবে, বুঝে উঠতে পারি না। আমার গলায় দোনোমনা টের পেয়ে আরও জোর দিয়ে ইমন বলল, ‘প্লিজ, আজই আয়।’

কী আর করা, তৈরি হয়ে মোহাম্মদপুর থেকে ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে উত্তরায় হাজির হলাম। বাসায় ঢুকে দেখি, সবার মধ্যেই সেই উপহার নিয়ে গুঞ্জন। কেউ কেউ বলছে, এই উপহারের বিনিময়ে তাদেরও কিছু উপহার দিতে হবে। সবার অবস্থা দেখে আমার আর তর সইছিল না। মনে মনে বিড়বিড় করছি, কী এমন জিনিস অপেক্ষা করছে আমার জন্য!

নাটকীয়তার অবসান ঘটিয়ে ইমন স্টিলের আলমারি থেকে ভাঁজ করা একটি কাগজ বের করে নিয়ে এল। বিছানার ওপর পুরোনো কাগজটি মেলে ধরল। লম্বা কাগজটিতে অনেক ভাঁজ পড়ে গেছে। ইমন বেশ আলতো হাতে কাগজটা ধরে বলল, ‘জানিস এটা কী?’

কিছুটা ঝাঁজালো কণ্ঠে বললাম, ‘রহস্য করিস না, তাড়াতাড়ি বল কী?’

‘দাদু আর দিদার কাবিননামা!’

কাবিননামায় বর ও কনের নাম–ঠিকানা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

অবাক হব, খুশি হব, নাকি আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পুরোনো কাগজপত্রের মধ্যে কাবিননামাটি খুঁজে পেয়েছেন আমার মা বেগম রহিমা খন্দকার। কাবিননামার পাঠোদ্ধার করতে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ি।

প্রথমে কাগজের উল্টো পিঠে কিছু লেখা আছে কি না দেখলাম। সেখানে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের সিলমোহর, M. M. R. & Rage (মুহামেডান ম্যারিজ রেজিস্ট্রার)। হাতে লেখা এই আদ্যক্ষরের ওপরে অফিসারের দস্তখত, তার নিচে দলিল সম্পাদনের স্থান ও তারিখ (ইসলামপুর, ২.৩.৪৩)। তার মানে ১৯৪৩ সালের ২ মার্চ দাদু আর দিদার বিয়ে হয়েছিল। এই অংশটুকু ইংরেজিতে লেখা।

কাগজটি আড়াআড়ি করে ধরলে অপর পৃষ্ঠায় শিরোনামে লেখা ‘কপি অব এন্ট্রিস অব রেজিস্ট্রার এ (বুক ওয়ান) আন্ডার সেকশন ১২, ১৫ অর ২২।’ এই বাক্য আরও দুটি ভাষায় লেখা—উর্দু তারপর বাংলা।

কাগজটিতে দাগ টেনে টেনে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি হাতে লেখার জায়গা, অন্য দুটি সেই খালি জায়গায় কী লিখতে হবে, উর্দু ও বাংলায় তার নির্দেশনা। একরকম ফরম পূরণ করার মতো।

এই সেই কাবিননামা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

কাবিননামায় যা আছে

কাবিননামায় বরকে ‘দুলহা’ আর কনেকে ‘দুলহান’ বলা হয়েছে। ফরমে বর-কনের বাবা, উকিলের নাম ও তাঁর বাবার নাম, উকিলের সঙ্গে দুলহানের কোনো ‘রেশতা’ বা সম্পর্ক আছে কি না, সাক্ষীদের নাম, মোহরানা ইত্যাদির পর শেষ অংশটি হলো ‘খাস কোনো শর্ত থাকিলে তাহা’। কাবিননামার এই অংশে লেখা হয়েছে আমার দিদার প্রতি আমার দাদার প্রতিশ্রুতি—

১. বিবিকে পর্দায় রাখিয়া রীতিমতো ভরনপোষণ করিব, নামাজ–রোজা শিক্ষা দিব।

২. বিবির বিনা অনুমতিতে দ্বিতীয় বিবাহ কি নিকাহ করিব না।

৩. ...(অস্পষ্ট) বিবিকে আমার নিজ ব্যয়ে তাহার পিত্রালয়ে বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাতায়াত করাইব।

৪. বিবির সহিত অমত হইলে তাহাকে তাহার পিত্রালয়ে রাখিয়া মাসিক ২৫ টাকা হারে খোরপোশ দিব।

৫. বিবিকে (অস্পষ্ট) তিন তালাক বায়েন করিবার আমার যে ক্ষমতা আছে ঐ ক্ষমতা আপন খুশিতে (অস্পষ্ট) অদ্যই অর্পন করিলাম। বিবি (অস্পষ্ট) আপন ইচ্ছানুয়ায়ী ঐ অর্পিত ক্ষমতা মূলে নিজ প্রাতী তিন তালাকে বায়েন করিয়া আমার সহিত বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করিতে পারিবেন।

দিদার স্মৃতি বলতে আছে এই তিনটি কাচের বাসন
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আক্রামুজ্জামান মিয়া ও লায়লা বেগমের স্মৃতি

আমার দাদার নাম আক্রামুজ্জামান মিয়া আর দিদার নাম লায়লা বেগম। দাদু ও দিদার কোনো ছবি আমাদের কাছে নেই। ছোটবেলায় দাদার অনেক ছবি দেখেছি, কিন্তু কোনোটিই সংরক্ষণ করা হয়নি। আর দিদার ছবি নেই, কারণ, মাত্র ১৯ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। আমার বাবা তাঁর মায়ের মুখাবয়ব অল্পস্বল্প মনে করতে পারতেন। এ জন্য আব্বুকে খুব স্পষ্ট করে তাঁর মা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। এখন আর সেই সুযোগও নেই।

জামালপুরের ইসলামপুরে আমাদের বাড়িতে দাদুর নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। প্রতিষ্ঠাতা আমার মা। স্কুলটি এখন সরকারি। আর দিদার স্মৃতি বলতে আমাদের কাছে আছে তিনটি কাচের বাসন। এই তিনটি জিনিসের গল্প আব্বু এভাবে বলেছিল, ‘আমার মা এগুলো চালের বিনিময়ে কিনেছিল। সে সময় অনেক নারী বাড়ি বাড়ি গিয়ে এগুলো বিক্রি করত।’

কাবিননামাটি বর্তমানে আমার সংগ্রহে রয়েছে। দাদা আর দিদার এই স্মৃতি যত্ন করে রেখে দিয়েছি।

আপনিও লিখুন

আগলে রাখা স্মৃতিময় কোনো স্মারক নিয়ে আপনিও লিখতে পারেন প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে। লেখার সঙ্গে স্মারকের ছবি পাঠাতে ভুলবেন না। নির্বাচিত লেখা ও ছবি প্রকাশিত হবে ‘স্মৃতির স্মারক’ বিভাগে।

লেখা পাঠানোর ঠিকানা

প্র ছুটির দিনে, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০-২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

ই-মেইল: [email protected]

ফেসবুক পেজ: fb.com/ChutirDine