এ শুধু গবেষণার দিন
গবেষণা শব্দটা শুনলেই মনে হয়, না জানি কত কঠিন। চর্চার মাধ্যমে কঠিন বিষয়টিও কিন্তু সহজে আয়ত্বে আনা যায়। গবেষণাকৌশল জানার সুযোগ আমরা খুব একটা পাই না। তাই অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যেই গবেষণা নিয়ে একধরনের ভীতি কাজ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয়েছিল গবেষণা ও প্রকাশনা মেলা। ২২ ও ২৩ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে বসেছিল এ মেলা।
উৎসবমুখর আয়োজন
এ মেলায় তুলে ধরা হয়েছিল বিভিন্ন বিভাগ, ইনস্টিটিউট ও গবেষণাকেন্দ্রের উদ্ভাবন, গবেষণা ও প্রকাশনা। আমি ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজে পড়ি। আমাদের স্টলে নানা ধরনের পোস্টার প্রেজেন্টেশন ছিল। এ ছাড়া বিভাগের শিক্ষক ও গবেষকদের আলোচিত গবেষণা ও কাজের কথা আমরা মেলায় আগত দর্শনার্থীদের সামনে তুলে ধরেছি।
আমাদের ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন প্রকল্প প্রদর্শনীর সুযোগও ছিল। আমাদের শিক্ষক ও গবেষকদের নানা বই, গবেষণাপত্র আমরা স্টলে রেখেছি। আগ্রহী দর্শনার্থীরা ঘুরে ঘুরে এসব দেখেছেন।
মেলায় অনুষদগুলোর জন্য ১০টি, ইনস্টিটিউটগুলোর জন্য ১টি, প্রকাশনা সংস্থার জন্য ১টি, গবেষণাকেন্দ্রগুলোর জন্য ১টিসহ মোট ১৩টি প্যাভিলিয়ন ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত প্রকাশনাসহ উল্লেখযোগ্য প্রকাশনাগ্রন্থ, জার্নালের বিশেষ সংখ্যা, গবেষণা প্রকল্প, পোস্টার, ফ্লায়ার, ব্রশিউর প্রদর্শন ও উপস্থাপন করা হয়। আমাদের এ মেলায় এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের গবেষণা হচ্ছে। গবেষণা ও প্রকাশনা মেলা আয়োজনের মাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের গবেষণার সুযোগ ও অনুপ্রেরণা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
নানা বিভাগ, নানা গবেষণা
প্রথম দিন ছিল কলা, বিজ্ঞান, আইন, ব্যবসায় শিক্ষা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের আলাদা উপস্থাপনা। পরের দিন জীববিজ্ঞান; ফার্মাসি; আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস; প্রকৌশল ও প্রযুক্তি এবং চারুকলা অনুষদের উপস্থাপনা দেখার সুযোগ হয়েছে। গবেষণা মানেই যে শুধু চোখে চশমা এঁটে বইপুস্তকে মুখ গুঁজে থাকা নয়, গবেষণা ও প্রকাশনা মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে বুঝেছি। যে শিক্ষককে ক্লাসে ভীষণ ভয় পাই, মাঠে দেখি তিনি দারুণ আগ্রহ নিয়ে গবেষণার অ আ ক খ শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে বলছেন। শুধু নিজের বিভাগের শিক্ষার্থীদের নয়, অন্য বিভাগ বা মেলায় আগত অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও আমাদের শিক্ষকেরা আগ্রহ নিয়ে সময় দিয়েছেন।
আমরা বন্ধুরা মিলে প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের স্টলে গিয়ে চমকে গিয়েছিলাম। সেখানে ল্যাবরেটরি থেকে নিয়ে আসা নানা প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রাখা। আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার শিক্ষার্থী, এসব তো সব সময় দেখার সুযোগ পাই না। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের স্টলে ক্লোন করা গাছ দেখে আরও চমকে গিয়েছিলাম। গল্প–উপন্যাসে যে ক্লোনিং করার কথা শুনেছি, তা সরাসরি দেখে বেশ রোমাঞ্চ লাগছিল।
কৌতূহল আর কৌতূহল
ইনফরমেশন সায়েন্স ও লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্টের স্টলে গিয়ে বই ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো জানার সুযোগ হয়েছে। বইপত্র গুছিয়ে রাখাও যে একটা কৌশল, আবার তা নিয়ে যে গবেষণাও হতে পারে, সেটা দেখেছি এই স্টলে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্টলে গিয়ে দেখা যায়, পুরো স্টল সংবাদপত্রে মোড়ানো। বাংলা বিভাগের বন্ধুদের দেখেছি, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্টলে খোঁজখবর নিতে, বিজ্ঞানীদের গবেষণা সম্পর্কে ধারণা নিতে। আবার প্রকৌশলের বন্ধুরাও ভিড় করছিলেন ব্যবসায় শিক্ষার স্টলে।
উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের স্টলে রেদিয়া আফরোজের সঙ্গে দেখা হলো। তাঁর ভাষ্য, ‘এই মেলা থেকে অনেক কিছু শিখেছি। কীভাবে শিক্ষক ও গবেষকেরা গবেষণা করেন, তার কলাকৌশল সম্পর্কে জেনেছি।’
আমি নিজেও এখন গবেষণা করতে ভীষণ আগ্রহী। রেদিয়ার সঙ্গে গল্প করতে করতেই দেখি, নানা স্টলে ঘুরে ঘুরে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করছেন একজন শিক্ষার্থী। আলাপে আলাপে জানা গেল, তিনি ফাইন্যান্সের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী, নাম পারভেজ মোশাররফ। বললেন, ‘ক্লাসরুমে গবেষণা নিয়ে জানার সুযোগ তুলনামূলক কম। এই সুযোগে কীভাবে গবেষণা করতে হয়, বিষয় বাছাই করতে হয়, এসব বিষয়ে দেশবরেণ্য গবেষকদের কাছ থেকে ধারণা নিয়েছি।’
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী নাস কবিরের সঙ্গে কথা হলো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে এত গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে, সেটা জানতে পারাই তাঁর কাছে বড় আনন্দ।
আগ্রহের শেষ নেই
দুই দিনের এই মেলা ছিল সব বিভাগ ও বিষয়ের শিক্ষার্থী ও প্রাক্তনীদের মেলবন্ধনেরও এক সুযোগ। সবাই যেন গবেষণার জন্য, গবেষণা নিয়ে কথা বলতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে এক হয়েছিলেন।
দল বেঁধে মেলায় এসেছিল অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি ও লিডারশিপ বিভাগের আশিক হোসেন, স্বাগতম চাকমা ও আদিত ইশরাক। আশিক বললেন, ‘সারা বছর বন্ধুরা এক হয়ে নানা জায়গায় ঘুরতে যাই। আজ এই মেলায় এসে চমকে গিয়েছি। বেশ ভালো ভালো কাজ ও গবেষণা হচ্ছে, এসব সম্পর্কে জানলাম।’
প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরাও আগ্রহ নিয়ে মেলা ও প্রেজেন্টেশন দেখেছেন। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী গীতা রানী সূত্রধর, সৈয়দা ফেরদৌসী জামান আর অত্রি পালকে দেখেছি গবেষণা ও প্রকাশনাগুলোয় চোখ বোলাতে। ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের দ্বিতীয় বর্ষের তাহমিদ বিন জামান, আশফাকুর রহমান ও মুশফিক রহমানও অনেকটা সময় মেলায় কাটিয়েছে। তাহমিদ বলছিলেন, ‘আমাদের এখনো গবেষণার সুযোগ হয়নি। কীভাবে শুরু করব, এ মেলা থেকে ধারণা পেলাম।’
আমাদের স্টলে এসেছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) সহ-উপাচার্য খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন। তাঁর হাত ধরেই আমাদের ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরু হয়। তিনি বলেন, ‘এখন অনেক তরুণ শিক্ষার্থী ও গবেষক গবেষণা নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তরুণদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার সুযোগ বাড়ছে। ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজে অনেক তরুণ ও নবীন গবেষকদের কাজ দেখছি। শিক্ষক হিসেবে নতুনদের গবেষণা দেখতে পাওয়াটা আনন্দের।’