তুই আমার ভাই হোস না!

ইন্টার্নশিপের অংশ হিসেবে বাক্‌, শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন লেখক
ছবি: সংগৃহীত

‘শিক্ষাই শক্তি, শিক্ষাই মুক্তি’—ছোটবেলা থেকে এই কথা বহুবার পড়েছি। এখনো স্পষ্ট মনে করতে পারি, বাবা কাঁধে চড়িয়ে এমন নানা বাক্য শেখাতেন। শিক্ষার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ঠিক সেই সময় থেকেই বলা চলে। মা-বাবা দুজনই শিক্ষক হওয়ায় শিক্ষামূলক কাজগুলোতে নিজেকে অনেক বেশি সম্পৃক্ত রাখার সুযোগ পেয়েছি সব সময়। তাই উচ্চমাধ্যমিকের পাট চুকিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম, তখন অন্য নানা বিষয়ে সুযোগ পেলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শিক্ষা ও গবেষণা’কে বেছে নিতে আমাকে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি।

ভর্তি হওয়ার আগে জানতাম না, এই অনুষদে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা (বিশেষ শিক্ষা) নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের তৃতীয় ব্যাচ থেকে আমরা যারা এ বিষয় নিয়ে পড়ছি, তাদের রাজশাহীর তিনটি বিশেষায়িত বিদ্যালয়ে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। আমার সুযোগ হয় শহরের ষষ্ঠীতলায় অবস্থিত পিএইচটি সেন্টারে। যেখানে মূলত বাক্‌, শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনার সুযোগ আছে।

এই সেন্টারে সুযোগ পাওয়াটাও একদিক থেকে আমার জন্য খুব ভালো হয়েছে। কেননা এই দুই ধরনের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য ইশারা ভাষা ও ব্রেইলের প্রয়োজন পড়ে। বিষয়গুলো সম্পর্কে তাত্ত্বিক কিছু জ্ঞান থাকলেও সরাসরি এই শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া ও যোগাযোগ করা মোটেও সহজ কাজ নয়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কথা বলে বোঝানো গেলেও বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ নেই। তাই শুরুতে প্রাথমিক যোগাযোগ ও ক্লাস পরিচালনার জন্য কিছু অতি প্রয়োজনীয় ইশারা ভাষা শিখে নিতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের শিক্ষক মরিয়ম জামিলা আপার কথা বিশেষভাবে বলতেই হয়। তাঁর সার্বিক সহযোগিতায় দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় ইশারা ভাষা শেখাটা সহজ হয়েছিল।

আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পাঠপরিকল্পনা অনুযায়ী ক্লাস নেওয়া ও শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করা। কেননা আগের সেমিস্টারগুলোতে বিভিন্ন কোর্সে আমরা জেনেছি—সঠিক পরিকল্পনা ও যথাযথ উপস্থাপনের মাধ্যমে পাঠকে কীভাবে আরও আকর্ষণীয় করা যায়। যখন এমন পরিকল্পনামাফিক উপকরণের সাহায্যে ক্লাসগুলো নিতে শুরু করলাম, তখন শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও পড়ালেখা উপভোগ করতে দেখাটাই ছিল সবচেয়ে আনন্দের।

ক্লাস নিতে গিয়ে এই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটা আবেগের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। ক্লাস নিতে নিতেই বুঝতে পেরেছি, অন্য শিক্ষার্থীদের তুলনায় এই প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের অনুভূতি খুব প্রবল। কথা বলতে পারে না, শুনতে পায় না, তবু তাদের আবেগের প্রকাশ তীব্র। ইন্টার্নশিপের শেষ দিনের একটা অভিজ্ঞতা বললে ব্যাপারটা হয়তো বুঝতে সুবিধা হবে।

আমি চতুর্থ শ্রেণিতে ক্লাস নিতাম। সেই ক্লাসের সবাই পুরোপুরি বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী হলেও সুমাইয়া আক্তার নামের এক শিক্ষার্থী আছে, যার বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা মধ্যম মাত্রার। ফলে কখনো কখনো কিছু কিছু শব্দ দিয়ে এলোমেলো বাক্য সে বলার চেষ্টা করে। যথারীতি শেষ দিনও চেষ্টা করল। যেটা বলার চেষ্টা করল তা হলো, ‘তুই ভালো। তুই আমার ভাই হোস না? যাস না, আমাদের পড়াবি!’ কিছুক্ষণের জন্য আমি থমকে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, সুমাইয়া তো কিছুটা হলেও প্রকাশ করতে পেরেছে তার অনুভূতি। কিন্তু যারা ইশারায় বলছিল, তাদের অনুভূতিটা যদি মুখে প্রকাশ করতে পারত! সেটি হয়তো সম্ভব নয়। তবু আমার ইন্টার্নশিপের পুরো যাত্রাটা ছিল এমন শেখা ও ভালোবাসাপ্রাপ্তির এক সোনালি সময়। যে সময়টা হয়তো আমার বাকি জীবনের চলার পথে সব সময় শক্তি জোগাবে।