ময়মনসিংহের বাতিঘর হিসেবে পরিচিত শত বছরের পুরোনো এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

ঐতিহ্যবাহী এই কলেজের অংশ হতে পারা অনেকের কাছে আনন্দের
ছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহের টাউনহল মোড়ের একদিকে একটি রাস্তা পরিচিত ‘কলেজ রোড’ নামে। হবে নাই–বা কেন! মোটামুটি এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই এক রাস্তাতেই যে আছে সরকারি-বেসরকারি পাঁচটি কলেজ। রাস্তা ধরে এগোলে সব শেষে চোখে পড়বে আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহের সবচেয়ে পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। মূল ফটকের ওপরেই লেখা আছে ‘জ্ঞানকে শক্তিতে রূপান্তরের রাজ্যে সুস্বাগতম’। শিক্ষার্থীদের তো বটেই, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দর্শনার্থীদের এভাবেই স্বাগত জানায় ময়মনসিংহ অঞ্চলের অন্যতম সেরা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

শুরু যেভাবে

ভেতরে প্রবেশ করলে সবার আগে নজরে আসে তিনটি ম্যুরাল, যার একটি আনন্দমোহন বসুর। তাঁর নামেই প্রতিষ্ঠিত এই কলেজ। শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারক আনন্দমোহন বসু ময়মনসিংহ শহরের রাম বাবু রোডে নিজ পৈতৃক ভিটায় ‘ময়মনসিংহ ইনস্টিটিউশন’ নামের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি পরে নানা ঘটনা পরম্পরায় ‘ময়মনসিংহ সিটি কলেজ’ হয়ে ওঠে। এই কলেজ ছিল মূলত কলকাতা সিটি কলেজের শাখা। প্রাথমিক অবস্থায় কলকাতা সিটি কলেজ কাউন্সিলের আর্থিক সহযোগিতায় ময়মনসিংহ সিটি কলেজ পরিচালিত হতো। কিন্তু ১৯০৬ সালে আনন্দমোহন বসুর মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠানটি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ময়মনসিংহ সিটি কলেজের প্রিন্সিপাল বৈকুণ্ঠকিশোর চক্রবর্তী ও ময়মনসিংহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ব্যাক উড কলেজটির পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। প্রাথমিকভাবে এই কমিটি ময়মনসিংহ সিটি কলেজের পরিচালনা ও যাবতীয় খরচের দায়িত্ব নেয়। তখন নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ময়মনসিংহ কলেজ’। ১৯০৮ সালের শেষ দিকে কলেজটিকে বর্তমান স্থানে আনা হয়। তখনই নাম হয় ‘আনন্দ মোহন কলেজ’। ১৯০৯ সাল থেকে পুরোদমে চালু হয় কলেজের কার্যক্রম।

আরও পড়ুন

ঐতিহ্যের সাক্ষী, গৌরবের সঙ্গী

কলেজের প্রশাসনিক ভবনটি ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীর কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই ভবন পেরিয়ে মূল প্রাঙ্গণে ঢুকতেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে দেখা হলো। কথায় কথায় জানালেন, ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানের অংশ হতে পেরে তাঁরা গর্বিত। খানিক বাদে কথা হলো কলেজটির দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সৌমত্ত আয়নের সঙ্গে। সৌমত্তর কাছে ক্যাম্পাস দ্বিতীয় বাড়ির মতো। বলছিলেন, ‘কলেজে ঢুকলেই একটা অন্য রকম প্রশান্তি কাজ করে। শতবর্ষের ঐতিহ্যে লালিত এই কলেজ বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কলেজগুলোর মধ্যে অন্যতম। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের এমন অনেক পরিবার আছে, যে পরিবারের তিন পুরুষ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়েছে।’

উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পড়ালেখার জন্য আনন্দ মোহন কলেজের বেশ সুনাম আছে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় এই কলেজের শিক্ষার্থীদের সুযোগ পাওয়ার হার কম নয়। তাই ২০২৩ সালেও উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তির জন্য সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছিল এই কলেজে। ৯৮১টি আসনের বিপরীতে ৪৬ হাজার শিক্ষার্থী আবেদন জমা দিয়েছেন, একক কলেজ হিসেবে যা সর্বোচ্চ। জিপিএ–৫ প্রাপ্তির ভিত্তিতেও সেরা তিন কলেজের একটি এই কলেজ।

শিক্ষার্থীদের তৈরি করার পেছনে কলেজের ভূমিকা কতটুকু? জানতে চেয়েছিলাম আনন্দ মোহন কলেজের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসানের কাছে। ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশ পেয়েছেন তিনি। মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমি ভাগ্যবান যে এই কলেজের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। আমার আজকের এই অবস্থানের পেছনে অবশ্যই কলেজের অনেক ভূমিকা ছিল। এখানকার পড়াশোনার পরিবেশ খুব ভালো। বিশেষ করে আমি আমার ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকদের কথা বলতে পারি। এমন দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।’

সহশিক্ষা কার্যক্রমে জোর

কলেজের একাডেমিক ভবনগুলোতে বিভিন্ন বিভাগের পাশাপাশি দেখা যাবে বিএনসিসি, রোভার স্কাউটসহ বিভিন্ন সংগঠনের কার্যালয়। সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত আন্তকলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতা ২০২৩-এ জাতীয় পর্যায়ে রানারআপ হয় আনন্দ মোহন কলেজের বিতার্কিক দল। টেলিভিশন বিতর্কেও কলেজটির সাফল্য ছিল নজরকাড়া। রক্তদাতা সংগঠন (বাঁধন), সাংস্কৃতিক পরিষদ, পরিবেশ ক্লাব, বোটানি ক্লাবের মতো নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও কলেজে বেশ সরব।

কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আমান উল্লাহও বিষয়টির প্রতি আলাদা গুরুত্ব দিলেন, ‘একাডেমিক ও সহশিক্ষা কার্যক্রমকে যুগপৎভাবে এগিয়ে নিয়ে আমরা আমাদের কলেজকে দেশ সেরা কলেজ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছি। তবে এককভাবে এই কাজ করা বেশ কঠিন। আমাদের সদিচ্ছার পাশাপাশি সরকারের সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, যারা বর্তমানে ভালো অবস্থানে আছে, তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।’