ঢাবির সমাবর্তনে অংশ নিচ্ছেন ছোট ভাই, তাঁকে বড় ভাইয়ের চিঠি

১৯ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তন। অনেক স্নাতকের মতো সমাবর্তনে অংশ নিচ্ছেন রায়হান রহমান। তিনি সংগীত বিভাগে পড়েছেন। খুশির দিনটিতে রায়হানকে চিঠি লিখেছেন তাঁর বড় ভাই সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপপরিচালক ফয়সাল খলিলুর রহমান

প্রিয় রাহিম

আব্বা প্রায়ই গর্ব করে একটা কথা বলেন, ‘আমি অর্থ-সম্পদ গড়তে পারিনি, আমার সমস্ত অর্থ ও সময় আমার সন্তানদের পেছনে বিনিয়োগ করেছি।’ বাবা নিশ্চয়ই আজ অনেক খুশি যে তাঁর ছেলে দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে সমাবর্তনে অংশ নিচ্ছে। তোকে ভালো ছাত্রের পাশাপাশি ভালো মানুষ বানাতে আমাদের পিতামাতা অনেক পরিশ্রম করেছেন। তুইও আমাদের হতাশ করিসনি। এ জন্য তোকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই। তোর স্কুল কলেজের শিক্ষকবৃন্দ এ গর্বের অংশীদার। বিশেষ করে সে সকল সম্মানিত শিক্ষকদের আজ স্মরণ করতে চাই, যাঁরা তোকে প্রাথমিক জ্ঞান বিতরণ করে ভালো ছাত্র হওয়ার ভিত শক্ত করেছিলেন। ছোটবেলা থেকে দেখেছি, ক্লাসে তোর রোল নম্বর সব সময় আগের দিকে থাকত। তুই গাছ ভালোবাসিস, প্রকৃতি ভালোবাসিস, বাংলাদেশের ঋতু নিয়ে কবিতা লিখিস, দেশীয় টানে সুর তুলিস, এমন গুণ সবার মধ্যে থাকে না। মাঝে মাঝে বিভিন্ন মানুষের কাছে এই প্রতিভাবান ভাইটির বড় ভাই হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিই। এটা আমার গর্বের জায়গা।

সদ্য স্নাতক ছোট ভাই রায়হান রহমানসহ (সমাবর্তনের পোশাকে) পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লেখক (সর্ববাঁয়ে)
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

তোর জন্মের পর আমাদের বাসায় গৃহস্থালি কাজে আম্মাকে সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না। তোকে আমার কোলে রেখে আম্মা সংসারে ব্যস্ত থাকতেন। সে সূত্রেই হয়তো বালক বড় ভাইয়ের সঙ্গে শিশু ছোটভাইয়ের একটি আত্মিক বন্ধন গড়ে উঠেছিল। মাথায় শর্ষের তেল আর কপালে নজর টিপ লাগিয়ে আমার কোলে যখন তুই ঘুমিয়ে পড়তিস, তখন তুই কি স্বপ্ন দেখতিস তা আমি মনে মনে ভাবতাম। খেলার ছলেই কি ভ্রাতৃত্বের ভিত শক্ত হয়েছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না, শুধু মনে হয়, আমার মিষ্টি–দুষ্টু কলিজার টুকরাটা এখন ‘বিগ ম্যান’ হয়ে গেছে। আমাদের ছোট্ট রিহানের মুখটাতেও আমি তোর চেহারা খুঁজে পাই। আউলবাউল মনের বলেই কি না, বড় হওয়ার পর আমি তোর তেমন যত্ন নিতে পারিনি। তার জন্য দুঃখিত। তবে আমাদের আরেক ভাই সৈকত আছে বলে চিন্তামুক্তও থেকেছি। তোর এই বিশেষ দিনে আমি সৈকতের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমার ধারণা, ক্যারিয়ার গঠনে আমাদের পরিবারে সবচেয়ে বেশি তোকে মানসিক সাপোর্ট দিয়েছে সৈকত। আমাদের বোন শশী একটু চুপচাপ, কিন্তু মনের গভীরে সে–ও তার ‘ছুডু বাইয়া’কে খুব ভালোবাসে। আমার বাবার পাঁচ সন্তান পাঁচ মেজাজের, সবাই যে যার মতো করে একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। সমাবর্তনের এই আনন্দের দিনে পরিবারের কথা বারবার বলছি এ জন্য যে তোর সুখ-দুঃখ সাফল্যে ব্যর্থতায় আমরা সব সময় আমাদের মতো করে তোর পাশে আছি।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিবর্তনের বিভিন্ন ধারায় মানুষ প্রকৃতি থেকে যেমন জ্ঞান লাভ করেছে, একতাবদ্ধভাবে এক ছাদের নিচে জড়ো হয়ে একের জ্ঞান অন্যের সঙ্গে বিনিময় করে আরও বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ হয়েছে। পরীক্ষা, ক্লাস, বন্ধুত্ব, ক্যাম্পাস একসময় শেষ হয়। বিশেষ করে সবাবর্তনের পর থেকে একটা অন্যরকম স্বাধীনতা অনুভব হয়। নদীর মাছ সমুদ্রে চলে এলে যেমন লাগে, তোরও তেমন লাগবে। শুরু হতে যাচ্ছে জীবনের আসল যুদ্ধ। তবে ভয় পাবি না। জীবন যেমন এত সহজ নয়, তেমন জটিলও নয়। অসাবধানতাবশত ভুল করে হোঁচট খেয়ে পড়েও যেতে পারিস। পড়ে যাওয়া কোনো অপরাধ নয়, পড়ে থাকা অপরাধ। প্রগতি আমাদের শিক্ষা দেয়, ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখিস, দিন শেষে আমরা সবাই একা। তাই যেখানেই থাকিস, যেভাবেই থাকিস, আনন্দে থাকবি, নিজেকে প্রচণ্ড ভালোবাসবি। প্রতিটি দিন কর্মক্ষম থাকবি, প্রতিটি সময় উপভোগ করবি। যদিও সাফল্যের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম, তবুও সাফল্যের উঁচু শিখরে পৌঁছাতে হলে পেছনের সিঁড়ি থেকে পা ওঠাতে হয়, ওপরের সিঁড়িতে আরেকটি পা বাড়াতে হয়। তবে সফলতার গড্ডলিকায় কখনো গা ভাসিয়ে দিস না। অহংকার যাতে কখনো তোকে গ্রাস না করে।

আজ তোর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী সমাবর্তনে অংশ নিচ্ছে। কালো গাউন উড়িয়ে নিজের ক্যাম্পাসে যখন তারা হেঁটে যাবে, নিজেদের খুব স্পেশাল মনে হবে। টুপি উড়িয়ে যেন তারা নিজের আনন্দকেই বাতাসে ছড়িয়ে দেবে। এই সুখী ভাবটা বজায় থাকুক। বিনয়ী হ, মায়াময় হ।

ইতি

বড় ভাইয়া