দেড়তলা উঁচু মঞ্চ থেকে পড়েও যেভাবে আবার দাঁড়ালেন রোকসানা
ছোটবেলায় রোকসানা কখনো ভেবেছেন সংগীতশিল্পী হবেন, কখনো চিত্রশিল্পী। সবশেষে আলোকচিত্রে যখন থিতু হলেন, তখনই বাধা হয়ে দাঁড়াল একটা দুর্ঘটনা। ২০১১ সালের মার্চে বিখ্যাত আলোকচিত্রী হাসান সাইফুদ্দিন চন্দনের সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। সে সময় এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছবি তুলতে গিয়ে প্রায় দেড়তলা উঁচু মঞ্চ থেকে পড়ে যান। এখন আর ভারী ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতে পারেন না রোকসানা ইসলাম। চলাফেরা করার ক্ষমতাটাও হারাতে বসেছিলেন। অর্থসংকটে রাজধানী ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে গিয়ে থেকেছেন প্রায় সাত বছর।
সেখানেই শুরু হয় কাগজশিল্প নিয়ে যাত্রা। ছোট থেকেই হস্তশিল্পের ওপর অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করত। কাউকে কিছু বানাতে দেখলেই চট করে সেটা বানিয়ে ফেলতে পারতেন রোকসানা ইসলাম। সেটাই হয়ে উঠল তাঁর কাজের নতুন মাধ্যম। প্রথমে ইউটিউবের ভিডিও দেখেই কাগজের জিনিসপত্র বানাতে শেখেন রোকসানা ইসলাম।
রাজধানীর লালমাটিয়ার সি ব্লকের ২/৬ নম্বর বাড়ি ‘দ্য ইলিউশনসে’ গত বৃহস্পতিবার শুরু হয়েছে কাগজশিল্প নিয়ে রোকসানা ইসলামের প্রথম একক প্রদর্শনী ‘পুনর্জীবন’। প্রদর্শনীর এমন নাম কেন, কারণ জানতে চাইলে রোকসানা বলেন, ‘আমি যেমন আবার উঠে দাঁড়িয়েছি, ঘুরে দাঁড়িয়েছি, তেমনি আমার শিল্পকর্মগুলোও সব ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে তৈরি, সে হিসেবে আমরা উভয়ই পুনরায় জীবন ফিরে পেয়েছি।’
কাগজ দিয়ে যে এত কিছু তৈরি করা সম্ভব, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না! গ্যালারির দেয়ালে ঝুলছে আয়না, টেবিলে ছোট ছোট ফটোফ্রেম কিংবা বিড়ালের ঘর—এই সবই কাগজ দিয়ে তৈরি করেছেন রোকসানা। কাগজ দিয়ে তৈরি করেছেন ফল ও সবজি রাখার ঝুড়ি, লন্ড্রির ঝুড়িসহ বিভিন্ন ধরনের ঝুড়ি। বিভিন্ন আকারের গয়নার বাক্স, পেনসিল রাখার বাক্স, কানের দুল, মালা, হাতের চুড়ি, খোঁপার বাঁধনসহ বিভিন্ন রকমের গয়নাও বানিয়েছেন কাগজ দিয়ে। রয়েছে নানা রকম পুতুল, হাতপাখা, গাড়ি, ল্যাম্পশেড, টেবিলম্যাট, সেলাই মেশিনের ঢাকনা, ব্যাগ, টিস্যু বক্স, ফুলদানি, মোমদানি। বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারযোগ্য ও ঘর সাজানোর কারুসামগ্রী।
খবরের কাগজসহ বিভিন্ন ধরনের কাগজ দিয়ে তৈরি হয়েছে প্রতিটি শিল্পকর্ম। আনুষঙ্গিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ফেলে দেওয়া নানা জিনিস। কাগজ পেঁচিয়ে বিশেষভাবে বুনে এসব জিনিস তৈরি করেন তিনি। রোকসানা ইসলাম বলেন, ‘কাগজ দিয়ে বানানো হলেও এখানকার প্রতিটি জিনিসই বেশ মজবুত।’ তাঁর এই কাজগুলোর জন্য আছে ‘আর ক্রিয়েশন’ নামের একটি ফেসবুক পেজ। তিনি চান, বাংলাদেশের বাণিজ্যিকভাবে কাগজশিল্পের প্রসার ঘটুক।
কাজের মাধ্যমে মানুষকে ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা দিতে চান রোকসানা। ২০১১ সালের সেই দুর্ঘটনা থেকে আজ পর্যন্ত এই দীর্ঘ যাত্রায় সব সময় তাঁকে সাহস দিয়ে গেছেন আলোকচিত্রী সাইদা খানম ও আলোকচিত্রী হাসান সাইফুদ্দিন চন্দন। পুরো প্রদর্শনীর সময়টাতেই রোকসানা ধৈর্য নিয়ে পুরো গ্যালারি ঘুরে ঘুরে অতিথিদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তাঁর কাজ দেখাচ্ছিলেন। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পাশাপাশি বলছিলেন তাঁর সংগ্রামের গল্প। প্রদর্শনীর প্রতিটি জিনিস তাঁর নিজের হাতে তৈরি করা। রোকসানা নিজেও দুহাতে পরে এসেছিলেন কাগজের চুড়ি।
তিনি এখন স্বাভাবিকভাবে হাঁটাহাঁটি করতে পারলেও ওঠাবসা করতে বেশ কষ্ট হয় তাঁর। তবু আগ্রহ নিয়ে মেঝেতে বসে দেখালেন কীভাবে খবরের কাগজ ভাঁজ করে তৈরি করেন এসব শিল্পকর্ম। গ্যালারি থেকে বের হওয়ার সময় অতিথিদের মন্তব্য করার জন্য রাখা আছে একটি ক্যানভাস ও একটি খাতা। সেই ক্যানভাসে তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘স্বপ্নটা পূরণ হলো, আমি পেরেছি।’
প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছেন নকশাবিদ, কারু ও বস্ত্রশিল্প গবেষক চন্দ্রশেখর সাহা এবং মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির। প্রদর্শনী চলবে ৭ মে পর্যন্ত। প্রদর্শনীটি প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।