কেউ ক্লাসফ্রেন্ড, কেউ আংকেল, কেউ আবার দোস্ত বলেও সম্বোধন করত

ইমামুল ইসলামের বাড়ি নাটোরের বাগাতিপাড়ায়। সম্প্রতি ছেলের সঙ্গে এসএসসি পাস করেছেন। ভালোও করেছেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুক্তার হোসেন

ছেলে আবু রায়হানের সঙ্গে আনন্দের সঙ্গে পড়তেন বাবা ইমামুল ইসলাম
ছবি: মুক্তার হোসেন

ফল প্রকাশের পর পরিচিতরা কী বলল?

ইমামুল ইসলাম: দোকান, গরু-ছাগল সামলিয়ে আমি যে পাস করতে পারব, এটা তাঁরা কল্পনাই করতে পারেননি। এখন সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছেন।

রেজাল্টও ভালো হয়েছে...

ইমামুল: হ্যাঁ। আমি পেয়েছি জিপিএ–৪.৭৯। আমার ছেলে আবু রায়হান পেয়েছে জিপিএ–৪.৮২। ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়েছি, সারা দিন রোজগারের পেছনে ছোটার পরও ভালো ফল করা যায়।

পড়াশোনা বন্ধ করেছিলেন কেন?

ইমামুল: ১৯৯৮ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা দুই ভাই ও এক বোন। বাবা তখন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। তাঁর চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার দরকার ছিল। অথচ সংসারে আয়–উপার্জন ছিল না। আবাদি জমি ছিল না। মাত্র দেড় কাঠা জমির ওপর বাড়িটা ছিল। বড় ভাই আনোয়ার হোসেন তখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। বাবা সিদ্ধান্ত দিলেন, বড় ভাই পড়ালেখা চালিয়ে যাক, আর আমি ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে কাজ করে উপার্জন করি। বাবার সিদ্ধান্তে পড়াশোনা ছেড়ে ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতে শুরু করি। 

 এই বয়সে এসে আবার পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নিলেন যে...

ইমামুল: আমার স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষিত হব। পারিনি। পরে ছেলেকে শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখলাম। কিন্তু আমার দুই ছেলে পড়াশোনায় ভালো করছিল না। ঠিকমতো পড়তে বসত না। তখন আমি আবার পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে নিজেও পড়তে বসতাম। তখন তারা বাধ্য হয়ে পড়তে বসত, স্কুলে যেত। ছেলেদের পাশাপাশি আমারও পড়াশোনা এগোতে শুরু করল।

সন্তানসম সহপাঠীদের সঙ্গে ক্লাস করতে কেমন লেগেছে?

ইমামুল: দুজনই বাগাতিপাড়া টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করলেও আমাদের বিভাগ ছিল আলাদা। তাই একই কক্ষে ছেলের সঙ্গে ক্লাস করা হয়নি। তবে যাদের সঙ্গে ক্লাস করেছি, তারা তো সন্তানসম ছিল। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আমাদের দুজনকেই চিনত। মজা করে কেউ আমাকে ক্লাসফ্রেন্ড, কেউ আংকেল, কেউ ভাই আবার কেউ দোস্ত বলেও সম্বোধন করত। আমি বিষয়টি উপভোগ করতাম। কাউকে বারণ করতাম না। বরং পড়াশোনা নিয়ে নিজে থেকেই তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করতাম।

পড়াশোনা করতেন কখন?

ইমামুল: কাজের মধ্যে সুযোগ পেলেই বই খুলে পড়তাম। তবে বেশির ভাগ পড়া হতো রাতের বেলা। যখন সবাই ঘুমাত। ছেলেকে সঙ্গে রাখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সে আমার আগেই ঘুমাতে যেত।

পরীক্ষার হলে বসে কী মনে হয়েছে?

ইমামুল: দীর্ঘ বিরতির পর পরীক্ষার হলে বসার কারণে প্রথম দিকে কিছুটা ভয় লাগত। প্রশ্ন কেমন হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ত। তবে পাশাপাশি এ–ও ভাবতাম, আমাকে ভালো করতেই হবে। আমার ফল দেখে আমার ছেলে অনুপ্রাণিত হবে। এ জন্য খুব অল্প সময়েই আমি লেখায় মনোযোগী হয়ে উঠতাম।

নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন...

ইমামুল: গার্মেন্টসে চাকরি করে বড় ভাইকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়িয়েছি। পরে চাকরি ছেড়ে বাড়িতে এসে বাড়ির সঙ্গেই ছোট একটা মুদিদোকান দিয়েছি। সেখানে কিছু উপার্জন করি। এ ছাড়া বাড়িতে গরু-ছাগল পালন করি। আমার স্ত্রী এ কাজে আমাকে সহযোগিতা করে। সব মিলিয়ে কোনো রকম সংসার চলে যায়। সীমিত সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে সংসারের তথা আমাদের অবস্থার পরিবর্তন করতে চাই। শিক্ষিত হতে চাই। এখন শিক্ষিত হয়ে হয়তো সরকারি চাকরি পাব না। কিন্তু মানুষ তো আমাকে অশিক্ষিত বলতে পারবে না। আমার ছেলেদের অশিক্ষিত লোকের ছেলে বলে গালি দিতে পারবে না।

এসএসসি তো পাস করলেন, এখন?

ইমামুল: আমার ছোট ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। বড় ছেলেসহ আমি এসএসসি পাস করলাম। এখন আমরা কলেজে ভর্তি হব। আগের মতোই পড়াশোনা চালিয়ে যাব। উচ্চশিক্ষিত হওয়ার চেষ্টা সব সময় থাকবে।