কৃষিকাজের উপযোগী রোবট তৈরি করে স্বর্ণপদক জিতেছেন এই শিক্ষার্থীরা

টিম এটলাসের সদস্যরা
ছবি: সংগৃহীত

‘পর্দায় ভেসে উঠল বাংলাদেশের নাম। পাশে স্বর্ণপদক। এই প্রতিযোগিতায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো দল সোনা জিতল, আমাদের মাধ্যমে আমার দেশকে চিনল, সেই মুহূর্তের অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না,’ বলছিলেন সানি জুবায়ের। টিম এটলাস নামে এক তরুণ দলের সদস্য তিনি। ইন্দোনেশিয়ার বালি থেকে এই দল বাংলাদেশের জন্য এনেছে স্বর্ণপদক।

ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড ইনভেনশন ফেয়ার (আইএসআইএফ) ২০২২–এর প্রযুক্তি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছে টিম এটলাস। ইন্দোনেশিয়ার ইয়ং সায়েন্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আইএসআইএফের এটি চতুর্থ আসর। ১ থেকে ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ, চীন, ইতালি, মেক্সিকোসহ ৩২টি দেশের ৫০৭টি দল। ৭টি ক্যাটাগরিতে দলগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।

একেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একেক জন

কোনো একটি নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের দল নয় ‘টিম এটলাস’। কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাত শিক্ষার্থী নিয়ে গড়া একটি স্বাধীন দল। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সানি জুবায়ের ও মীর তানজীদ আহমেদ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির মীর সাজিদ হাসান ও মাহতাব নেওয়াজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাহিম শাহরিয়ার, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের খোন্দকার মারুফ বিন ইসলাম এবং বিএএফ শাহীন কলেজ, কুর্মিটোলার তানজীর আরাফাত।

দলের প্রতিষ্ঠাতা সানি জুবায়ের স্কুল পর্যায় থেকেই রোবটিকস চর্চার সঙ্গে যুক্ত। আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে ব্রোঞ্জও পেয়েছেন তিনি। বলছিলেন, ‘সব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব দল বা ক্লাব থাকে। তবে সেখানে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ সদস্য হতে পারে না। তাই সবার জন্য একটা মঞ্চ তৈরির প্রয়োজনীয়তা বোধ করছিলাম। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যেখানে সদস্য হতে পারবে, একসঙ্গে কাজ করবে, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে। এই ভাবনা থেকেই ২০১৬ সাল থেকে টিম এটলাস রোবটিকসের বিভিন্ন শাখায় কাজ করছে।’ বর্তমানে ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী টিম এটলাসের সঙ্গে যুক্ত আছেন। নিজেদের পকেটের টাকা দিয়েই তহবিল গঠন করেন তাঁরা। কাজ করার জন্য তাঁদের আছে একটি স্বতন্ত্র ল্যাব।

টিম এটলাসের তৈরি রোবট
ছবি: সংগৃহীত

রোবট করবে চাষবাস

অনলাইনে আইএসআইএফ প্রতিযোগিতার প্রাথমিক পর্বে যেকোনো কিছু নিয়েই কাজ করার সুযোগ ছিল। শুধু শর্ত ছিল এমন একটি বিষয় বেছে নিতে হবে, যেটা বৈশ্বিক প্রভাব ফেলতে সক্ষম। টিম এটলাস সিদ্ধান্ত নেয়, কৃষি ও খাদ্য নিয়ে কাজ নিয়ে কাজ করবে। দলনেতা সানি বলেন, ‘আমরা মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করি। বিভিন্ন রকম সমস্যার কথা উঠে আসতে থাকে। ফসল উৎপাদনে কৃষকদের প্রতিবন্ধকতা খোঁজা এবং সে অনুযায়ী সমাধান বের করাই আমাদের লক্ষ্য ছিল। তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে জানলাম, ফসল কাটার লোক পাওয়া যায় না, ঠিক সময়ে সার দেওয়া যায় না, বীজ ছিটানোর সময় কোথাও কম পড়ে কোথাও বেশি পড়ে, এমন নানা সমস্যা আছে।’

সমস্যাগুলো মাথায় নিয়ে টিম এটলাস একটা রোবট বানায়। নাম ‘ফ্রিমো-এ ফারমিং রোবট’। তাঁদের এই স্বয়ংক্রিয় রোবটের আছে নানা বৈশিষ্ট্য। রোবটের সঙ্গে যুক্ত কাটার দিয়ে অনায়াসেই কাটা যাবে ধান ও ঘাস, দেওয়া যাবে নিড়ানি৷ রিমোট কন্ট্রোলে রোবটটিকে নিয়ন্ত্রণও করা যাবে। কৃষক চাইলে সফটওয়্যার বা অ্যাপের মাধ্যমেও রোবটটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।

রোবটে বীজ বপনের জন্য আছে তিনটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। বীজ দেওয়ার পরিমাণ ও সময় ঠিক করে দিলেই কৃষকের কাজ শেষ। এ ছাড়া সার, কীটনাশক বা কোনো স্প্রে দেওয়ার দরকার হলে রোবট নিজেই পরিমাণ মতো স্প্রে করতে সক্ষম। শুধু প্রয়োজনীয় তরল পদার্থ রোবটের ট্যাংকে ভরে দিলেই হবে।

ধান বা ফসল কাটার পরে সেটা এক স্থান অন্য স্থানে নিতেও সক্ষম এই রোবট। একবারে ৪০ কেজি ওজন বহন করতে পারবে। এ ছাড়াও এক জমি থেকে কী পরিমাণ শস্য পাওয়া গেল, সেটার তথ্য সংরক্ষণ করবে এবং স্থানীয় কৃষি অফিসে পাঠাতে পারবে এই রোবট। যেমন, পি এইচ লেভেল কত, তাপমাত্রা কত, সূর্যের আলো কেমন ছিল ইত্যাদি। মাসে একবার সার্ভারে এসব তথ্য পাঠাবে রোবট। সৌরচালিত রোবটটি পরিচালনায় বিদ্যুৎ খরচও কম হবে।

কষ্টের ফল

প্রত্যাশার থেকে প্রাপ্তি বেশি। কিন্তু এ অর্জনের পেছনে রয়েছে অনেক দিনের শ্রম। দলের সদস্য মীর সাজিদ হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশের কোনো দল আগে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেনি। তাই আমাদের প্রত্যাশার পারদ যে খুব উঁচুতে ছিল, তা কিন্তু নয়। মোটামুটি একটা ফল হলেই হয়তো খুশি হতাম। তবে অন্যদের প্রজেক্টগুলো দেখার পর আমাদের একটু আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে।’ একটু মন খারাপের সুরে সাজিদ যোগ করলেন, ‘বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত ওজন দেখিয়ে আমাদের রোবটের বক্সটা আটকে দিয়েছিল। পরে রোবট নিতে পারলেও ড্রাইসেল ব্যাটারি রেখে যেতে হয়েছে। ফলে ওখানে যেয়ে অতিরক্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে, সবকিছু নতুন করে সাজাতে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কর্তৃপক্ষ হয়তো এই প্রতিযোগিতাগুলো সম্পর্কে জানে না। তাই এসব বিষয়ে যদি সবার সহযোগিতা পাওয়া যায়, তাহলে খুব ভালো হয়।’

কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একক দল না হওয়ায় নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তেমন সাহায্যও পাননি সানিরা। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো পৃষ্ঠপোষক হতে রাজি হয়নি। নিজেদের পকেটের টাকায় প্রতিযোগিতায় গিয়েছেন দলের সদস্যরা। স্নাতকোত্তরের ছাত্র ফাহিম শাহরিয়ারের বক্তব্য, ‘স্পনসর না থাকায় পুরো খরচ মেটাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। মানি এক্সচেঞ্জেও একটু সমস্যা হয়েছিল। শেষের দিন তো পানি কিনে খেতেও দুইবার চিন্তা করতাম। একটা ৩৫০ মিলির পানির বোতল ৬ জন ভাগ করে খেয়েছি। তবে, কষ্ট বৃথা যায়নি। গোল্ড মেডেলের কাছে এসব কষ্ট কিছু না।’

দলের একেক শিক্ষার্থী একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের হওয়ায় কিছুটা বাড়তি সুবিধাও যে আছে, সে কথাও বললেন ফাহিম, ‘আমাদের শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই আলাদা নয়, অনেকের ব্যাকগ্রাউন্ডও আলাদা। পড়ার বিষয় আলাদা। তাই সবার ভাবনার পরিসরটা ভিন্ন। এই ভিন্নতা আমাদের জ্ঞান ভাগাভাগি এবং দক্ষতা প্রয়োগে বেশ কাজে দিয়েছে। একটা কাজের ফল পেতে বিভিন্ন দিক দিয়ে চিন্তা করতে হয়। আমাদের দলে বৈচিত্র্য থাকার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।’

স্বর্ণপদক তো বড় প্রাপ্তি বটেই। তবে টিম এটলাস মনে করে, তাঁদের রোবটটি আরও উন্নত করে বাংলার কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারাই হবে সবচেয়ে বড় আনন্দের।