নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন নারীরা। বাজারের তুলনায় কম দামে পণ্য কিনতে টিসিবির লাইনে অপেক্ষা
ছবি: সাজিদ হোসেন

‘আগে পাঁচ লিটারের বোতল থেকে তেল ঢেলে রান্না করতাম। মাংস কষানো, চিংড়ি বা লইট্যা শুঁটকি ভুনায় তেল না ভাসলে ঠিক মনঃপূত হতো না। আর এখন তেল ঢালার জন্য একদম ছোট মুখের একটি বোতল কিনেছি, যা দিয়ে চাইলেও খুব বেশি তেল ঢালা যায় না। মাসিকের কিছু জটিলতার কারণে স্যানিটারি ন্যাপকিন বেশি পরিমাণে লাগছে বলে মনটা খচখচ করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে নতুন কিছু অসুখ বাসা বেঁধেছে। তবে নিয়মিত ওষুধগুলো তো আর বাদ দেওয়া যাচ্ছে না।’

এ কথাগুলো বললেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মালিহা খাতুন। থাকেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে। শুধু মালিহা খাতুন নন, হুট করে জিনিসপত্রের বাড়তি দামের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে এভাবেই কাটছাঁট বা বিকল্প ব্যবস্থাপনার দিকে ঝুঁকছেন নারীরা। ডিম, দুধ বা ভালো খাবারটা না খেয়ে আলগোছে তা তুলে রাখছেন সন্তান বা স্বামীর জন্য। সব মিলিয়ে পুরো চাপটাই গিয়ে পড়ছে নারীর মন ও স্বাস্থ্যের ওপর।

অক্টোবর মাসেই প্রকাশিত বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) ‘বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা ও বিপন্নতা পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে খাবার কিনতে হিমশিম খাওয়া মানুষের হার ৬৮ শতাংশ। গত মার্চ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ৮টি বিভাগের ১ হাজার ২০০ মানুষের ওপর করা এই জরিপ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, খাদ্যের চড়া দাম মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় আঘাত। এরপরের আঘাতগুলো হচ্ছে রোগ ও চিকিৎসা ব্যয়, তেলের দাম ও পরিবহন ব্যয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

রান্না করা বা সংসার সামলানোর দায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীকে বহন করতে হয়। তাই জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ার বাড়তি বোঝা চেপে বসেছে নারীর কাঁধে। ২০ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, অক্টোবর মাসের হিসাবে মাছ-মাংস না খেয়েও ঢাকা শহরের ৪ সদস্যের একটি পরিবারকে মাসে এখন খাবার কিনতে গড়ে ৯ হাজার ৫৯ টাকা খরচ করতে হয়। আর মাছ-মাংস খেলে ওই পরিবারের খাবারে খরচ হয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। আর গত পৌনে চার বছরে খাবার কেনায় ওই সব পরিবারের খাবারের খরচ ২৭ থেকে ৩৮ শতাংশ বেড়েছে।

রাজধানীর আবাহনী মাঠের কাছে ফুটপাতে রিকশা মেরামতের কাজ করেন নাসিমা বেগম। তাঁর মা নাজমা বেগমও একই পেশায়। নাসিমা রিকশামিস্ত্রির কাজ করে কোনো দিন যেমন ৫০০ টাকা পান, কোনো দিন আবার আয় করেন মাত্র ২০০ টাকা। পরিবারে মা-সহ ছয়জনের খাবারের জোগান দেন নাসিমা। এর মধ্যে ঘরভাড়াতেই চলে যায় পাঁচ হাজার টাকা। বড় মেয়ে পড়ছে নবম শ্রেণিতে, ছোট মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। তারা সুরভী স্কুলে (বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পরিচালিত স্কুল) পড়ছে বলে বই-খাতা কেনা ও যাতায়াত খরচ ছাড়া আর কোনো খরচ লাগে না। তবে মেয়ের প্রাইভেট ও আরবি পড়াতে মাসে খরচ তিন হাজার টাকা। নাসিমার ভাষায়, তাঁর স্বামী ‘বাদাইম্যা’, এক দিন কাজ করলে বাকি ছয় দিন বসে থাকেন।

নাসিমা বলেন, ‘মাছ-মাংস খাওয়া বাদ দিছি। ডাল-আলু ভর্তা খাই। ডিমের হালি ৬০ টাকা। সবজিও ৫০-৬০ টাকার কমে কেনা যায় না। আগে কোনো জিনিস আধা কেজি কিনলে তা এখন আরও কমাইয়্যা কিনি। নিজে সংসার চালাই, তাই নিজে একটু কমই খাই, যাতে অন্যদের খাবারে টান না পড়ে।’

রিকশামিস্ত্রি নাসিমা বেগম খাবারের তালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিয়েছেন
ছবি: মানসুরা হোসাইন

১৭ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্ত হন ভার্চ্যুয়ালি। এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচতে দেশবাসীকে ফসল উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি খাদ্যের অপচয় কমানোর অনুরোধ করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠান একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা বলছেন।

রাজধানীর গ্রিন রোডে থাকেন নাজলী নাহিদ। তিনি গৃহিণী। স্বামী সরকারি একটি সংস্থায় চাকরি করেন। দুই মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সেই অর্থে নাজলী নাহিদের পরিবারে কখনোই অভাব ছিল না। তারপরও নাজলী নাহিদ কোন কোন খাতে কাটছাঁট করেছেন, তার ফিরিস্তি দিলেন। এই পরিবার এখন বাইরে রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া, যখন-তখন মেয়েদের জন্য বার্গার, পিৎজা কেনা, ডিম ও চিনি দিয়ে খাবার বানানো ইত্যাদি বাদ দিয়েছেন। অতিথি আপ্যায়নে পটু নাজলী এখন যখন-তখন দাওয়াত দেওয়া বা খেতে যাওয়া—দুটোই কমিয়ে দিয়েছেন। আগে ভবনের অন্য বাচ্চাদের নিয়ে প্রায়ই চড়ুইভাতি করতেন, সেটাও বাদ দিয়েছেন। অনলাইনে বাজারে অনেক সময় পচা সবজি বা মাছ কিনতে হতো। এসব অপচয় করতে এখন আর সাহস পান না। তার বদলে পাড়ার ভ্যান বা দোকান থেকে যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই কেনেন। সবজি বেশি কেনা হয়ে গেলে তা ভাপ দিয়ে ফ্রিজে রেখে দেন। অথচ কয়েক মাস আগেও তিনি এসব নিয়ে ভাবতেন না।

নাজলী নাহিদ বললেন, ‘মাংস না কষিয়ে ঝোল বা অন্য কোনোভাবে রান্না করি। সবজিতে পেঁয়াজ দিই না। আগে সবাই সকালে নাশতায় ডিম খেলেও গায়ে লাগত না। এখন সবজি বা অন্য কিছু থাকলে ডিমটা আর খাবারের তালিকায় রাখি না। এখন প্রায় সময়ই একটা ডিম আমি আর আমার কাজের সহকারী ভাগ করে খাই। তেল, নুন যাতে কম খরচ করে, তার জন্য কাজের সহকারীকে তদারক করতে হয়। সব মিলিয়ে এই চাপ আমাকেই সামলাতে হচ্ছে। আগে থেকে সতর্ক থাকছি, যাতে খুব খারাপ অবস্থায় পড়তে না হয়।’

জিনিসপত্রের দাম কতটুকু বেড়েছে, তা টের পাচ্ছেন বিউটি পারলার কারু কর্নারের মালিক আফসানা রোজি। মোহাম্মদপুরে নিজের বাসার একটি কক্ষেই তিনি তাঁর পারলার চালাচ্ছেন। করোনার ধাক্কায় একবার ব্যবসায় ধস নেমেছিল। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। তবে এখন নারীরা জরুরি প্রয়োজন ছাড়া পারলারে আসাই ছেড়ে দিয়েছেন বলে মনে করেন রোজি। আগে যিনি পারলারে এসে দামি স্পা বা অন্য কোনো সেবা নিতেন, তিনিই পারলারে এসে এখন সবচেয়ে কম খরচের সেবা নিতে চাচ্ছেন।

আফসানা রোজি বললেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে পারলারে যাব কি না, সেটা আমি নিজেও ভাবতাম। পারলারের বিভিন্ন পণ্য এক মাস আগে যে টাকায় কিনেছি, পরের মাসে ওই টাকায় তা আর কিনতে পারছি না। একই খরচে কম পণ্য নিয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।’

২০০৯ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর এই সৌন্দর্যসেবা কেন্দ্রের আয় দিয়েই নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে, মা-সহ তিনজনের খরচ সামলাচ্ছেন তিনি। তাই পারলারের ব্যবসা না চললে জীবনের তাগিদেই বিকল্প কোনো ব্যবসার সন্ধান করতে হবে, বললেন আফসানা রোজি।

নারী ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, যেকোনো দুর্যোগ বা নাজুক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন নারী ও শিশুরা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, করোনা, ডেঙ্গু, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া, এ ধরনের পরিস্থিতিতে চাপটা বেশি পড়ে নারীদের ওপর। সংসার চালানোর ব্যবস্থাপনার দায়ও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিতে হয় নারীকে। নারী নির্যাতনের রিপোর্ট হোক বা না হোক, এ ধরনের পরিস্থিতিতে নারী নির্যাতনের ঘটনা বাড়বে, তা স্বাভাবিক ঘটনা বলেই ধরে নিতে হবে। বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ দারিদ্র্য। বর্তমানে জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে, অনেক পরিবারই চাইবে মেয়ের বাল্যবিবাহ দিয়ে হলেও একটি মুখ কমাতে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।