নতুন চ্যাম্পিয়ন, নতুন গল্প, নতুন নায়ক
১৫ ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেলটা গড়াচ্ছিল সন্ধ্যার দিকে। জাতীয় স্টেডিয়ামের ঘাসে তখনো লেগে আছে দমবন্ধ করা লড়াইয়ের উত্তাপ। ইস্পাহানি-প্রথম আলো তৃতীয় আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবলের ফাইনাল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কে জিতবে, কে হারবে—জানত না কেউ।
টাইব্রেকারের স্নায়ুচাপ যখন শেষ হলো, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি) জয়োৎসবে মেতে উঠল। গ্যালারির একাংশে হাওয়ায় ভাসছিল কয়েক হাজার তরুণ-তরুণীর উচ্ছ্বাস। অন্যদিকে হারের হতাশায় গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবলার ও সমর্থকেরা বাকরুদ্ধ। আনন্দ-বেদনা শেষে যখন সবাই ফিরতে শুরু করেছে, ঠিক সেই সময় এআইইউবির এক কর্মকর্তা হাসতে হাসতে বললেন, ‘এই টুর্নামেন্টে আগামীবার দেখবেন, কতগুলো দল খেলতে চেয়ে আবেদন করে! বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবলে এটিই এখন সবচেয়ে আকর্ষণীয় টুর্নামেন্ট।’
শুনে মনে হলো, জাতীয় স্টেডিয়ামের এই ঘাসে শুধু একটি শিরোপার লড়াই শেষ হলো না, জন্ম নিল এক নতুন আন্দোলনেরও। তরুণ ফুটবলাররা যেখানে স্বপ্ন দেখে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে নিজেদের গর্ব খুঁজে পায়। বছর ঘুরে আবার ফিরে আসবে এই টুর্নামেন্ট। আর প্রতিবারই বয়ে আনবে নতুন গল্প, নতুন নায়ক আর পড়ন্ত বিকেলের এমনই আরেকটি কাব্যিক দৃশ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফুটবলের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে ইস্পাহানি ও প্রথম আলো ২০২৩ সালের জুলাইয়ে যে উদ্যোগ নিয়েছিল, সেটি আজ আর শুধু একটি টুর্নামেন্ট নয়; ক্যাম্পাসের ক্লাসরুম, ক্যানটিন ছাপিয়ে ফুটবল ঢুকে পড়েছে শিক্ষার্থীদের নিত্যদিনের কথোপকথনে। কে কার বিপক্ষে খেলছে, কোন দলে কোন খেলোয়াড়—এসব নিয়ে ক্যাম্পাসে আলোচনা জমেছে চায়ের কাপে, হোস্টেলের ব্যালকনিতে। সবকিছুর যোগফল—ফুটবল টুর্নামেন্ট ছাপিয়ে এটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মঞ্চ আর সম্মানের লড়াইও।
তিনবারে তিন দল চ্যাম্পিয়ন
তিনবারে তিন দল চ্যাম্পিয়ন—এই টুর্নামেন্ট নেই কারও একক আধিপত্য। প্রথম আসরে ছিল গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্ছ্বাস, দ্বিতীয়বার শিরোপার মুকুট উঠেছিল ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মাথায়। আর এবার এআইইউবির পতাকা উড়ল বাতাসে। গত আসরে ফাইনালের হার এআইইউবিকে হতাশ করেছিল। সেই হতাশা মুছে এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কোনো টুর্নামেন্টে শিরোপা জিতেছে তারা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে দলটির।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়েছে
এবারের আসরে ৪৫ ম্যাচের মধ্যে ১৫টিই গড়িয়েছে টাইব্রেকারে। এর অর্থ হলো, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়েছে। বেড়েছে ‘কেউ কাউকে ছাড় না দেওয়ার’ মানসিকতা। টুর্নামেন্টে ভালো লড়াই করার জন্য খেলোয়াড় কোটায় ফুটবলার ভর্তির আগ্রহ বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে। এআইইউবিসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় খেলোয়াড় কোটায় ছাত্র ভর্তি করছে আগে থেকেই।
টাইব্রেকার নায়কের আসনে বসিয়েছে দেশের শীর্ষ ক্লাব বসুন্ধরা কিংসের গোলকিপার এআইইউবির মেহেদী হাসানকে। টুর্নামেন্টের নিজ দলের প্রথম ম্যাচে গতবারের চ্যাম্পিয়ন ড্যাফোডিলের বিপক্ষে টাইব্রেকারে তিনটি শট আটকান তিনি। এরপর ফাইনালে টাইব্রেকারে একটি সেভ। দুই ম্যাচ খেলে দুটিতেই মেহেদী হয়েছেন ম্যাচসেরা।
ম্যাচসেরা হয়েছেন আরও কয়েকজন গোলকিপার। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলকিপার লূহর চাকমা খুলনার আঞ্চলিক ফাইনালে টাইব্রেকারে দুটি শট আটকেও দলকে জেতাতে পারেননি। খুলনায় খেলা দেখতে গিয়ে জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ও গোলকিপার এবং টুর্নামেন্ট কমিটির সদস্য বিপ্লব ভট্টাচার্য লূহরকে মঞ্চে ডেকে বিশেষ পুরস্কার দেন। বিপ্লব বলেন, ‘এই টুর্নামেন্টে বেশ কয়েকজন তরুণ গোলকিপারকে দেখেছি, যাদের নিয়ে আমি কাজ করতে চাই। পরিচর্যা করলে ওরা ভালো গোলকিপার হতে পারবে।’
কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্সিতে খেলেছেন বিদেশি শিক্ষার্থীও। যেমন ড্যাফোডিলের প্রথম ম্যাচে ৮-০ গোলের জয়ে একাই পাঁচ গোল করেন নাইজেরিয়ান শিক্ষার্থী আবু বক্কর ইউনুসার। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) প্রথম ম্যাচে জোড়া গোল করে ম্যাচসেরা হন ওমর ওয়াজিরি। এমন অনেক খেলোয়াড়ই নজর কেড়েছেন আলাদাভাবে।
প্রথম আসরের সেরা খেলোয়াড়, জাতীয় অনূর্ধ্ব-২৩ দলের ডিফেন্ডার মাহমুদুল হাসান কিরণের সৌজন্যে এবার ড্যাফোডিলের মাঠে দেখা যায় বিরল এক দৃশ্যও। কোয়ার্টার ফাইনালের টাইব্রেকারে চিটাগাং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির বিপক্ষে তাঁর দল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত গোলকিপার কোনো শট ঠেকাতে পারছিলেন না। এমন অবস্থায় খোদ অধিনায়ক কিরণ হাতে নেন গ্লাভস, নিজেই দাঁড়িয়ে যান পোস্টের নিচে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি।
টুর্নামেন্টের ৪৫টি ম্যাচই মাঠে বসে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় দল অনায়াসেই দেশের দ্বিতীয় সারির যেকোনো ক্লাবের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। ড্যাফোডিল, এআইইউবি, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, ফারইস্টের মতো দলগুলো যেন পেশাদার কাঠামোয় গড়া ফুটবল টিম। দেশের ফুটবলে শীর্ষ স্তর বাংলাদেশ লিগের অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছেন অনেকেই। চ্যাম্পিয়ন এআইইউবিতে খেলেছেন পুলিশ এফসির গোলকিপার আসিফ ভূঁইয়া, দলের আক্রমণভাগে মঈন আহমেদ, ঢাকার মোহামেডানের ডিফেন্ডার আজিজুল হক; রহমতগঞ্জের আলফাজ মিয়া, আরামবাগের মিডফিল্ডার আক্কাস আলী ও ওমর ফারুক মিঠু, মোহামেডানের ফরোয়ার্ড সৌরভ দেওয়ান।
রানার্সআপ গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বলতম নাম রাফায়েল টুডু, যিনি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। দলটির তিন গোলকিপারই বাংলাদেশ লিগের। পিডব্লিউডির রাহুল হোসেন, অনিক আহমেদ, আর আবাহনীর শামীম হোসেন। রক্ষণে ছিলেন রহমতগঞ্জের স্টপার সিফাত শাহরিয়ার ও ফকিরেরপুল ইয়ংমেনসের সাব্বির হোসেন। গত মৌসুমে পেশাদার ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে পিডব্লিউডির হয়ে খেলা রিফাত হাসানও ছিলেন। আক্রমণে ছিলেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের ফরোয়ার্ড সাইফ সামশুদ।
ঢাকার বাইরের দল হিসেবে এবার চমক দেখিয়েছে চিটাগং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি। এই প্রথম দলটি ঢাকায় এসে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে। আর কোয়ার্টার ফাইনালে হারিয়ে দিয়েছে টুর্নামেন্টের প্রথম আসরের সেমিফাইনালিস্ট জাহাঙ্গীরনগরকে।
জাতীয় স্টেডিয়ামে খেলার রোমাঞ্চ
টুর্নামেন্টের প্রথম দুবার ঢাকা অঞ্চল ও চূড়ান্ত পর্বের সব ম্যাচ হয়েছে সাভারের বিরুলিয়ায়, ড্যাফোডিলের মাঠে। সেখানকার মনোরম ক্যাম্পাসে এবারও হয়েছে ঢাকা অঞ্চল ও কোয়ার্টার ফাইনালের খেলা। কিন্তু সবচেয়ে বড় রোমাঞ্চ এসেছে ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামে। প্রথমবার সেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে সেমিফাইনাল ও ফাইনাল। জাতীয় স্টেডিয়ামের মাঠে নামার অভিজ্ঞতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য ছিল দারুণ অভিজ্ঞতা।
প্রথম নারী কোচ
প্রথমবারের মতো ডাগআউটে দেখা গেছে একজন নারী কোচকে। আইইউবিএটির ডাগআউটে ছিলেন সাবেক জাতীয় অ্যাথলেট খুরশিদা আক্তার খুশি। মাঠে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতিটি নির্দেশনা, দলকে জেতানোর চেষ্টা ছিল চোখে পড়ার মতো। টুর্নামেন্টের প্রথম আসরে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ম্যাচে ৩২ মিনিট ভারপ্রাপ্ত কোচের ভূমিকায় ছিলেন সাবেক ভারোত্তোলক মোল্লা সাবিরা সুলতানা।
জাতীয় দলের সাবেক ওপেনার জাভেদ ওমর ছিলেন ঢাকার প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির কোচ। প্রথম ম্যাচেই তাঁর দল ৭-২ গোলে উড়িয়ে দেয় ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশকে (আইইউবি)। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির কোচ ছিলেন ঢাকা আবাহনীর সাবেক স্ট্রাইকার সাইফুল ইসলাম খোকন, ফুটবলপাড়ায় যাঁর পরিচিত ‘পুলিশ খোকন’।
মাঠে যখন জামাল ভূঁইয়া
২০ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলা স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার উপস্থিতি পুরো আয়োজনকে দিয়েছে বিশেষ মাত্রা। তাঁর উচ্ছ্বাস ফুটবলারদের স্পর্শ করেছে। চট্টগ্রামের খেলোয়াড়েরা ছবি তুলেছেন, সমর্থকেরা অটোগ্রাফ নিয়েছেন। মুহূর্তগুলো যেন চিরস্থায়ী হয়ে গেছে ফুটবলপ্রেমীদের মনে।
চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকার ড্যাফোডিল এবং জাতীয় স্টেডিয়াম—প্রতিটি ভেন্যু ছিল সুসজ্জিত। প্রতিটি ম্যাচে ইস্পাহানির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন ম্যাচসেরার পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে। তাঁদের উৎসাহ ও আগ্রহ ছিল টুর্নামেন্টের সফল আয়োজনের বড় অনুষঙ্গ।
ঢাকার আঞ্চলিক আর চূড়ান্ত পর্বের ম্যাচগুলো পরিচালনা করেছেন আগের দুবারের মতো দেশের সেরা রেফারিরা। সেই সঙ্গে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী মাঠে এসেছেন। তাঁদের উচ্ছ্বাস, গলা ফাটানো চিৎকার মিলিয়ে মাঠ হয়ে ওঠে উৎসবমুখর, যেখানে ফুটবলের আনন্দ ও উত্তেজনা মিলেমিশে একাকার হয়েছে। সব ভেন্যুতেই টুর্নামেন্ট পরিচালনা কমিটির সদস্য ও জাতীয় দলের সাবেক তারকাদের উপস্থিতি উৎসাহ দিয়েছে খেলোয়াড়দের।