বিশ্বে ছাত্রদের নেতৃত্বে শীর্ষ ১০টি আন্দোলন
ইয়েমেনের সাংবাদিক তাওয়াক্কুল কারমান আরববিশ্বের প্রথম নোবেল বিজয়ী নারী। তিনি বলেছিলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ভূমিকা শ্রেণিকক্ষেই শেষ নয়। ইতিহাস বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদা অর্জনের স্বপ্নপূরণের পথে সব সময়ই ভূমিকা রাখে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনগুলো।’
ইতিহাস বলে, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সব সময়ই শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলন। হোক সরকার উচ্ছেদ কিংবা বড় সংস্কার, ছাত্ররা প্রায়ই থেকেছে পরিবর্তনশীল বিভিন্ন আন্দোলনের অগ্রভাগে। বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত ছাত্র আন্দোলন এই তালিকার সর্বশেষ বড় উদাহরণ। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছেন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারাই। বিশ্বজুড়ে পরিবর্তন আনা ছাত্রদের নেতৃত্বে সংঘটিত এ ধরনের ১০টি ঐতিহাসিক আন্দোলনের কথা জেনে নেওয়া যাক।
১. জুলাই গণ–অভ্যুত্থান (বাংলাদেশ, ২০২৪)
২০২৪ সালে বাংলাদেশে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন যে আন্দোলন শুরু হয়, সেটি ছিল মূলত কোটা সংস্কারকেন্দ্রিক। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলে–মেয়ে, নাতি-নাতনিদের জন্য বরাদ্দকৃত কোটার পুনর্মূল্যায়ন ছিল মূল দাবি।
কিন্তু আন্দোলন দমাতে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের লাগামছাড়া বক্তব্য উসকে দেয় বিক্ষোভকে।
১৬ জুলাই প্রকাশ্যে গুলির আঘাতে শহীদ হন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া আবু সাঈদ। এরপর শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি পথে নামে জনতাও। ফলে এই আন্দোলন ক্রমেই গণ–অভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
এই অভ্যুত্থান চলে প্রায় এক মাস। সরকারি হিসাবে, এখন পর্যন্ত শহীদ হয়েছেন ৮৪৪ জন। আহতের সংখ্যা ১৩ হাজারের বেশি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করে।
এই অভ্যুত্থান আবারও প্রমাণ করেছে, দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে তরুণ সমাজের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
২. হংকং আন্দোলন (চীন, ২০১৪ ও ২০১৯)
‘আমব্রেলা আন্দোলন’ সংঘটিত হয় ২০১৪ সালে। বিতর্কিত ‘বহিষ্কারবিরোধী আইন সংশোধন বিল’-এর প্রতিবাদে হয় ২০১৯ সালে। দুটি আন্দোলনের সম্মুখভাগেই ছিলেন ছাত্ররা। দেশটির গণতান্ত্রিক সংস্কার ও হংকংয়ের ওপর বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিরোধিতা করে এ দুটি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
নির্বাচনী ব্যবস্থায় পরিবর্তনই ছিল প্রথম বিক্ষোভের মূল বিষয়। নিজেদের নেতা বাছাইয়ের সুযোগ চাইতেই রাস্তায় নামেন প্রতিবাদকারীরা। পুলিশের কাঁদানে গ্যাস ও পিপার স্প্রে থেকে বাঁচতে সবাই ছাতা নিয়ে আসতেন।
এ জন্যই এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আমব্রেলা আন্দোলন’। উভয় আন্দোলনই আন্তর্জাতিক মহলে দৃষ্টি কাড়ে। ফলে দেশটির চলমান সংকটে নজর পড়ে বিশ্ববাসীর।
৩. চিলি ছাত্র বিক্ষোভ (চিলি, ২০১১-২০১৩)
এই ক্ষোভের কারণ ছিল চিলির অন্যায্য শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার্থীরা খেয়াল করেন, ধনী শিক্ষার্থীরা লাতিন আমেরিকার সেরা কিছু স্কুলে পড়ার সুযোগ পান। অথচ দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ জরাজীর্ণ রাষ্ট্রীয় স্কুল। থাকে না পর্যাপ্ত তহবিল।
তাই বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং বিনা মূল্যে মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থার দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করে ছাত্ররা। এটি দ্রুতই লাভ করে জনসমর্থন। লাখো শিক্ষার্থী-জনসাধারণ রাস্তায় নামেন।
আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র ছিলেন ছাত্রনেত্রী কামিলা ভ্যালেজো। এই আন্দোলনের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংস্কার করা হয়। বৃদ্ধি করা হয় শিক্ষার জন্য সরকারি তহবিল। প্রভাব পড়ে সামাজিক নীতিমালাতেও।
৪. ভেলভেট বিপ্লব (চেকোস্লোভাকিয়া, ১৯৮৯)
বর্তমানে চেকোস্লোভাকিয়া নামে কোনো দেশ নেই। ১৯৯৩ সালে তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে গঠিত হয় দুটি দেশ। একটি চেক রিপাবলিক এবং অন্যটি স্লোভাকিয়া।
দেশ ভাগের দুই বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগে প্রতিবাদ শুরু করেন ছাত্ররা। বার্লিন ওয়াল পতনের ঠিক এক সপ্তাহের মাথায়, কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ।
তাঁরা দাবি করেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সরানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। উল্টো ধীরে ধীরে যোগ দেয় বিভিন্ন বয়সের মানুষ। ২০ নভেম্বরের মধ্যে প্রায় ৫ লাখ মানুষ প্রাগের রাস্তা ও ওয়েনসেচলাস স্কয়ারে জড়ো হয়।
ভেলভেট বিপ্লব নামে পরিচিত এই আন্দোলনের কারণে দেশটির সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তৈরি হয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পথ। অবসান ঘটে চার দশকের কমিউনিস্ট শাসনের।
৫. তিয়েনআনমেন স্কয়ার আন্দোলন (চীন, ১৯৮৯)
১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে নামেন চীনের শিক্ষার্থীরা। রাজনৈতিক সংস্কার, বাক্স্বাধীনতা এবং সরকারি দুর্নীতির ইতি টানাই ছিল লক্ষ্য।
ওই বছরের জুনে প্রতিবাদ চরম আকার ধারণ করে। এতে অংশ নেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী। যোগ দেয় সাধারণ নাগরিকও। চীন সরকারের কঠোর দমন-পীড়নে প্রাণ হারায় বহু মানুষ।
তবে এই আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হয় সরকার। কিন্তু নিপীড়ক শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে তিয়েনআনমেন স্কয়ার আন্দোলন।
এই আন্দোলনকে আজও চীনের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে ধরা হয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তায় স্মরণ করা হয় এই আন্দোলন।
৬. কোরিয়ান গণতান্ত্রিক বিদ্রোহ (দক্ষিণ কোরিয়া, ১৯৮০)
গুয়াংজু বিদ্রোহ নামে পরিচিত এই প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ছাত্ররা। স্বৈরাচারী সামরিক শাসক কান দু-হোয়ান সরকারের বিরুদ্ধে সংগঠিত এই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল দুটি।
সামরিক শাসন তুলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং নাগরিক স্বাধীনতা। কারণ, ১৯৭৯ সালে এই শাসক ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বন্ধ হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক কার্যক্রম। আটক করা হয় ভিন্নমতাবলম্বীদের।
১৯৮০ সালের মে মাসে প্রতিবাদ শুরু হয়। ১০ দিনের গুয়াংজু বিদ্রোহে শত শত মানুষ নিহত বা নিখোঁজ হন। সামরিক বাহিনীর কঠোর দমননীতির ফলে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে দক্ষিণ কোরিয়ায় গণতন্ত্র চালু এবং বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করেছিল এই আন্দোলন।
৭. ইরানিয়ান বিপ্লব (ইরান, ১৯৭৯)
ইরানের শাহ (রাজা) হিসেবে পরিচিত শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির উৎখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ইরানের ছাত্রসমাজ। এর মাধ্যমেই আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির (বর্তমানে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা) নেতৃত্বে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের উত্থান ঘটে।
রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, অর্থনৈতিক সংকট এবং সাংস্কৃতিক উত্তেজনার বিরুদ্ধে অসন্তোষের প্রতিবাদে ১৯৭৭ সাল থেকেই আন্দোলন শুরু হয়। চলতে থাকে ক্রমাগত ধর্মঘট, বিক্ষোভ।
প্রতিবাদের মুখে ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে দেশত্যাগে বাধ্য হন মোহাম্মদ রেজা পাহলভি। আমূলে পাল্টে যায় ইরানের রাজনৈতিক দৃশ্যপট। এমনকি গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই গভীর প্রভাব ফেলে এই বিপ্লব।
৮. সোয়েটো বিদ্রোহ (দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৯৭৬)
দক্ষিণ আফ্রিকায় তখন চলছিল শ্বেতাঙ্গদের শাসন। অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষমতা শুধু শ্বেতাঙ্গদের হাতেই থাকত। এর মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বর্ণবাদী সরকারের স্কুলগুলোতে সব বিষয় পড়ানো হবে আফ্রিকান ভাষায় (আফ্রিকানাস)। অথচ বেশির ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী তখন আফ্রিকান বলতে পারতেন না। ফলে এটিকে অত্যাচারীর ভাষা হিসেবে দেখতেন কৃষ্ণাঙ্গরা।
১৯৭৬ সালের ১৬ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার হাজার হাজার স্কুলের শিক্ষার্থী প্রতিবাদ জানাতে নেমে আসে সোয়েটো শহরের রাস্তায়। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে গুলি চালায় পুলিশ। নিহত হয় শত শত শিক্ষার্থী।
এই নৃশংস সহিংসতাকে নিন্দা জানায় আন্তর্জাতিক মহলও। তীব্রতর হয় প্রতিরোধ। এই আন্দোলনই পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যবাদী শাসনের পতনে ভূমিকা রাখে, যা পরিপূর্ণতা পায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে।
৯. জয়প্রকাশ নারায়ণ আন্দোলন বা সম্পূর্ণ ক্রান্তি (ভারত, ১৯৭৫)
জয়প্রকাশ নারায়ণ আন্দোলন বা জেপি আন্দোলন হয়েছিল ভারতের বিহারে। নেতৃত্ব ছিল ছাত্রদের হাতেই। বিহার রাজ্য সরকারের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল শিক্ষার্থীরা।
তবে মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামী প্রবীণ জয়প্রকাশ নারায়ণ (জেপি)। এই বিক্ষোভে অনেক ছাত্র নিহত হন। পরবর্তী সময়ে বিক্ষোভ চলতে থাকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের বিরুদ্ধে। দাবি ওঠে তাঁর পদত্যাগেরও।
পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি করেন ইন্দিরা গান্ধী।
ভারতের ছাত্ররা গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধার এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের দাবি জানান।
এই আন্দোলন ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে হেরে যান ইন্দিরা গান্ধী। প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় ক্ষমতা হারায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। প্রত্যাহার হয় জরুরি অবস্থা।
১০. মে ১৯৬৮ আন্দোলন (ফ্রান্স, ১৯৬৮)
১৯৬৮ সালের মে মাস। শিক্ষার্থীদের একের পর এক ধর্মঘট ও প্রতিবাদে উত্তাল হয় ফ্রান্স। ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ, শীতল যুদ্ধের কারণে অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিণতি এই বিক্ষোভকে ত্বরান্বিত করে।
তবে ফ্রান্সের স্কুলগুলোর ভয়াবহ অবস্থা এই বিক্ষোভের আরেকটি বড় কারণ। দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি যোগ দেন লাখো শ্রমিক। শুরু হয় বৃহৎ সাধারণ ধর্মঘট। বন্ধ হয় কলকারখানা।
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট চার্লস ডি গল কোনোমতে নিজের গদি বাঁচাতে সক্ষম হন। তবে এই আন্দোলনের ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। শিক্ষা ও শ্রমিক আইনের সংস্কারসহ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিবর্তন আসে। ফ্রান্সের প্রত্যেক মানুষের মনেই এই আন্দোলন স্থায়ী দাগ কেটেছিল।
সূত্র: রিপাবলিক ওয়ার্ল্ড, টাইমস, ডয়চে ভেলে, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস