অফিস-সংসার সামলে তাঁরা বনে-জঙ্গলে ছবি তোলেন

শৌখিন এই পাঁচ নারী আলোকচিত্রী একসঙ্গে ছবি তোলেন
ছবি: সংগৃহীত

শখের বশে মুঠোফোনে ছবি তুলতেন মৌসুমি সিরাজ। ২০১৯ সালে এসে মনে হলো, নিজের একটা ক্যামেরা দরকার। কিনেও ফেললেন। এরপর থেকে ছবি তোলাটা আরও নিয়মিত হলো। তবে সমস্যাও বাধল। মৌসুমির বন্য প্রাণীর ছবি তোলার শখ। কিন্তু সঙ্গীর অভাবে দূরে কোথাও গিয়ে ছবি তুলতে পারেন না। অফিস চত্বর আর বাড়ির আশপাশে গাছপালায় বসা প্রাণীর ছবি তুলেই মেটাতে হয় শখ। একসময় মনে হলো, যেসব সমস্যার সম্মুখীন আমি হচ্ছি, অন্য কোনো নারীও হয়তো একই সমস্যায় ভুগছেন। তাদের নিয়ে একটা দল করে ফেললে কেমন হয়! ফেসবুকে আলোকচিত্রীদের বিভিন্ন গ্রুপে যুক্ত হতে থাকলেন। খোঁজ করলেন নারীদের মধ্যে কারা কারা বন্য প্রাণীর ছবি তোলেন। একসময় আকলিমা আক্তার ও ফাতেমা কিবরিয়া নামে দুজনকে পেয়ে গেলেন। পরে দলে ভিড়লেন রেহানা বেগম ও সোফিয়া জামান। দলনেতা মৌসুমি সিরাজ বলেন, ‘আমরা কেউ চাকরি করি, কেউ গৃহিণী। তবে অফিস-সংসার সামলে এই একটি জায়গায় নিজেদের খুঁজে পাই।’

আরও পড়ুন
লম্বা গলার গয়ারের শিকার দৃশটি তুলেছেন রেহানা বেগম

প্রথম যাত্রায় নৌকা বিকল

পাঁচজনের দলটির কেউ থাকেন ঢাকা, কেউ ঢাকার বাইরে। তবে ছবি তুলতে যাওয়ার পরিকল্পনা হলেই এক হয়ে যায় গন্তব্য। ২০২১ সালে প্রথম একসঙ্গে ছবি তুলতে যান তাঁরা। সেবার তাঁরা গিয়েছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক বিলে। সেই যাত্রায় প্রথমবারের মতো ধলা কপাল রাজহাঁসের দেখা পান, ফ্রেমবন্দী করেন দুর্লভ সাদা লেজ টিটি। পরদিন রাজশাহীর বিভিন্ন চরে ঘুরে ঘুরে পাখি দেখা ও ছবি তোলা চলে। চর থেকে ফিরে আসার সময়ই বিপত্তি। হঠাৎ বিকল হয়ে যায় তাঁদের নৌকা। মাঝপদ্মায় সন্ধ্যা তখন ঘনিয়ে আসছে। দলের একজনের ভয় অন্যদেরও গ্রাস করে। শেষমেশ আরেকটি নৌকা এসে তাঁদের উদ্ধার করে। তীরের দেখা পেতে পেতে রাত প্রায় নয়টা।

এরপর থেকে ফুরসত পেলেই দেশের বিভিন্ন জেলায় ছুটে যান। ক্যামেরায় ধারণ করেছেন উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান, সবুজ বোড়া সাপ, তক্ষক, লজ্জাবতী বানর, বুনো হাতি, ধনেশ, নীলকণ্ঠসহ প্রায় ৪০০ প্রজাতির প্রাণী ও পাখির ছবি। ছবি তোলার পাশাপাশি নারীদের দলটি পাখি দেখা, সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণ অভিযান পরিচালনা করে থাকে।

আরও পড়ুন
পাখিটি উড়তে উড়তে মুখে তুলে নিল শিকার
ছবি: রেহানা বেগম

ক্যামেরা কাঁধে জলে-জঙ্গলে

একবার পদ্মার চরে ছবি তুলতে গিয়ে গাঙচষা পাখির দেখা পান তাঁরা। বিপত্তি বাধায় ইঞ্জিন নৌকা। এই নৌকা চরের কাছে গেলেই পাখি উড়ে যাবে। তাই চরের কাছে এসে নদীতেই নেমে পড়েন তাঁরা। কিছু দূর সাঁতরে পায়ের নিচে মাটি পেলেন। আস্তে আস্তে চরে উঠে কাঙ্ক্ষিত ছবিটা তুলে ফেললেন।

বনে-জঙ্গলে ছবি তুলতে গেলে মশা-জোঁকের সাক্ষাৎ যে মিলবে, এটা কি আর বলতে হয়। ২০২০ সালে চট্টগ্রামের হাজারিখিল অভয়ারণ্যে এমনই এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। রেহানা বেগম স্মৃতিচারণা করেন, ‘সেবার পাখির ছবি তুলতে বের হয়েছি। তখনো জঙ্গলে ছবি তুলে আমি অভ্যস্ত না। বর্ষাকালে সাপ-জোঁকের উপদ্রব থাকে। যে ভয়টা পাচ্ছিলাম, সেটাই হলো। হঠাৎ আমার পায়ে জোঁক ধরে। সেই জোঁক ফেলে দেওয়ার পরও রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। সেই অবস্থায় আমার এক সঙ্গী জানায়, আমরা যে পাখিটির ছবি তুলতে এসেছি, সেটি দেখা গেছে। সব ভুলে আবার জঙ্গলে ফিরে যাই। কিন্তু পাখিটা যেখানে ছিল, তার ঠিক নিচেই দেখি অনেক জোঁক। এত জোঁক একসঙ্গে দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠি। পাখিটা উড়ে যায়। সেদিন ছবি না তুলেই ফিরে আসি। সবার মন খুব খারাপ হয়।’

ছবি তুলতে গিয়ে নৌ দুর্ঘটনা, দুর্গম গ্রামে অচেনা বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া, অল্পের জন্য সাপের ছোবল থেকে রক্ষাসহ অনেক গল্পই এখন এই শৌখিন আলোকচিত্রীদের ভান্ডারে আছে।