চার মাসের চেষ্টার ফসল মাছরাঙার এই ছবি

মাছরাঙার এই ছবি তুলেছেন পঞ্চগড়ের আলোকচিত্রী ফিরোজ আল সাবাহ। চার মাসের চেষ্টার ফসল এই ছবি। কিন্তু এত সময় কেন লাগল? আলোকচিত্রী নিজেই সেই গল্প শোনালেন।

মাছরাঙার ভাবখানা যেন—আমি মানি নাকো কোনো মানা!ছবি: ফিরোজ আল সাবাহ

খুঁটির মাথায় জুড়ে দেওয়া ছোট এক ফালি কাঠে তিন শব্দের সতর্কবার্তা, ‘মাছ ধরা নিষেধ।’ এমন কড়া নির্দেশনার ওপরই ঠোঁটে মাছ নিয়ে নির্বিকার বসে আছে একটা মাছরাঙা। সাত বছর আগে সাত মাসের চেষ্টায় ছবিটি তুলেছিলাম। মানুষ বেশ পছন্দ করেছিল, বাহবা দিয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে ছবিটি আমার নিজের অত পছন্দ হয়নি। আবার তুলব তুলব করে এত দিন চলে গেল। কিন্তু সেই অতৃপ্তি আর গেল না। সাত বছর পর আবার মনে হলো, দেখি না চেষ্টা করে।

গত ডিসেম্বরে শুরু হলো ‘মাছ ধরা নিষেধ’ প্রকল্প! পুকুর নির্বাচন হলো। অন্য একটা পুকুর থেকে দেশি মাছ ধরে আনা হলো। বসার জায়গা বানালাম পুকুর পাড়ে। ক্যামেরা নিয়ে বসতেই বুঝলাম পুকুরের ধারে সবুজের ছিটেফোঁটাও নেই। ব্যাকগ্রাউন্ড মোটেও ভালো আসছে না। পুকুর পাড়ে ঘাস লাগানো শুরু করলাম। এ সময় সবুজ ঘাসের বড্ড অভাব থাকে। এদিক-সেদিক থেকে সবুজ ঘাস এনে ক্যামেরার বিপরীতে পুকুর পাড় ভরে ফেললাম। পানি ও সার দেওয়া হলো নিয়মিত। এসব করতে করতে দিন পনেরো চলে গেল। ঘাস তত দিনে সবুজ চেহারা ফিরে পেল।

সাত বছর আগে সাত মাসের চেষ্টায় তোলা ছবিটি

এর মধ্যে বোর্ড তৈরির কাজও চলল। কাঠের ওপর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে লেখা থাকবে—মাছ ধরা নিষেধ। কামারশালায় গিয়ে একজনকে বুঝিয়ে বললাম। তিনি বললেন, ‘কোনো ব্যাপার না!’

কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখা গেল তাঁর হাত কাঁপে। একে একে আটটা বোর্ড নষ্ট হলো। তারপর তৈরি হলো, ‘মাছ ধরা নিষেধ’ বোর্ড।

শীত যায়, বসন্ত আসে

সব প্রস্তুত করতে করতে জানুয়ারি পেরিয়ে ফেব্রুয়ারি চলে এল। তারপর শুরু হলো অপেক্ষা। সকাল সাতটায় বাড়ি থেকে বাইক নিয়ে বের হই। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে পুকুর পাড়ে বসি। ছবি তোলার ফাঁকে নাশতাটা সেরে ফেলি।

আরও পড়ুন
ফিরোজ আল সাবাহ
ছবি: সংগৃহীত

মাছরাঙা চলে আসে আমার আগেই। একদফা নাশতাও হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় আমাদের শিকার পর্ব—মাছরাঙা মাছশিকারি, আমি ছবিশিকারি। টানা ৩৬টা সকাল এভাবে পুকুর পাড়ে কাটল। ছবি যা পেলাম, মন ভরল না। তবে কিছু আইডিয়া পেলাম। সে আইডিয়া কাজে লাগিয়ে আবার ছবি তোলা শুরু করি।

মাছরাঙাও দারুণ ফাজিল। বোর্ড থেকে ঝাঁপিয়ে মাছ ধরে ঠিকই, কিন্তু খায় গিয়ে অন্যখানে। কাঙ্ক্ষিত ছবির জন্য আমার অপেক্ষা দীর্ঘ হতে থাকে। পুকুরের পাশের সবুজ ধানের খেত হলুদ হয়ে যায়। শীত গিয়ে গরম চলে আসে। সকালের পর আস্তানায় টেকাই দায় হয়ে পড়ে। ফলে ছবি তোলার সময় কমে যায়। শুধু মাছ ধরার ছবিই তোলা হয় না।

অনেক দিন ধরেই কাজকর্ম নেই। শখের ছবি দিয়ে তো আর পেট ভরে না। কিছু অ্যাসাইনমেন্ট করতে শুরু করলাম। বসন্তে নতুন করে সেজে উঠল প্রকৃতি। শিমুল, পলাশ ও মান্দারে প্রকৃতিতে আগুন ধরে গেল।

আরও পড়ুন

তারপর এক সকালে

বসন্তের এমনই এক অলস সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবলাম, আজ আর না যাই। বরং আরেকটু ঘুমাই। কিন্তু মন মানল না। বের হয়ে গিয়ে বসলাম চেনা আস্তানায়।

সকাল আটটা। মিষ্টি রোদে আরাম করে বসে আছি। কোথা থেকে হুট করে একটা মাছরাঙা এসে বসল। এসেই তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মাছকে নিশানা করতে লাগল। মাছ ধরবে ধরবে অবস্থা! এই দিল দিল ভাব করতে করতে ড্রাইভ দিয়ে দিল। ড্রাইভের ছবিটা তুলতে পারলাম না। কারণ, একটাই ক্যামেরা বের করেছি, সেটা আবার বোর্ডের দিকে তাক করা।

মাছ ধরেই কয়েক মাসের নিয়ম ভেঙে সে বোর্ডে এসে বসল। আর বসবি তো বস একেবারে আমার দিকেই মুখ করে। বসার আগেই শাটার চেপে ধরেছি। মেশিনগানের মতো চলতে থাকল ক্যামেরা। মাছরাঙাও মুখে চেপে ধরা পুঁটিকে কাবু করতে বোর্ডে আছাড় মারতে থাকল। একসময় প্রমাণ সাইজের পুঁটিটাকে টুপ করে পেটে চালান করল।

মুহূর্তে যে ঘটনাটা ঘটল, তার জন্য আমাকে কিন্তু চার মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে!