জেন–জিদের মনের খোঁজ রাখছেন কি
তারুণ্য মানেই উদ্যম, উদ্বেলিত মানসিক শক্তি। কবি নজরুলের ভাষায়—‘আমি অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খল,/আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!/আমি মানি নাকো কোনো আইন,/আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!’
তারুণ্য মানেই একেকটা ভাসমান মাইন। তারুণ্য মানে নিয়ম-কানুন-শৃঙ্খল ভাঙার গতি। তবে সে গতি হতে হবে অবশ্যই মানুষের জন্য প্রয়োজনীয়, উপকারী আর কাঙ্ক্ষিত। জুলাই আন্দোলনের গতি এবং তার ফলাফল শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা হয়তো রাজনৈতিক বিবেচনার বিষয়। কিন্তু মনোরোগবিদ হিসেবে আমাদের উদ্বেগ হলো, এই তারুণ্যের জয়গান গেয়ে আমাদের দেশের লাখ লাখ তরুণ যেভাবে রাস্তায় নেমেছে, আন্দোলন করেছে, নিজের জীবনের কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে বন্দুকের সামনে—সেসব ঘটনা, কাঙ্ক্ষিত-অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফল তরুণ আর তারুণ্যের মনে কতটুকু প্রভাব ফেলেছে?
বৈজ্ঞানিকভাবেই বলা হয়, তারুণ্য যেকোনো কিছুতে চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করে। তাদের যোগাযোগ দক্ষতা ভালো, তারা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশ নিতে পছন্দ করে। তারুণ্যের আরও একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো—বন্ধুবান্ধব নিয়ে থাকা এবং তাদের চাহিদা পূরণের দিকে বেশি ঝোঁক থাকা। জুলাই আন্দোলনে এ বিষয়টি স্পষ্ট ছিল। সারা দেশে কিশোর–তরুণেরা একটি সমবেত শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। একে অপরকে কখনো ছেড়ে যায়নি।
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে একধরনের অভিভাবকত্ব থাকে। কিন্তু তারুণ্যের ঐক্যে অভিভাবকত্ব নয়, বরং বিশ্বাসের দৃঢ়তা আর উচ্ছ্বাস থাকে। স্বেচ্ছাশ্রমেও তরুণেরা সাধারণত আনন্দ পায়। তারুণ্যের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো—বিভিন্ন কাজের ভেতর দিয়ে নিজের ব্যক্তিত্বকে বুঝিয়ে দেওয়া। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব বৈশিষ্ট্য পারিবারিক, সামাজিক বা অন্যান্য নিয়ম আর কানুন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত থাকে বলে সব সময় ঠিক দৃশ্যমান হয় না। তরুণদের এ বৈশিষ্ট্যগুলো অবদমিতই থেকে যায়।
আরও একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো, সেটি হলো তরুণেরা, বিশেষ করে যাদের বলা হয় আর্লি-অ্যাডাল্ট, তাদের চাহিদা বা উদ্দেশ্য যদি একে অপরের সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে তারা সংঘবদ্ধ থাকতে পছন্দ করে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুঁকি নিতেও পিছপা হয় না।
কেমন আছে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য
মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন তত্ত্ব আর তথ্য ঘাঁটলে দেখা যায়, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর শুরু হয় তুলনামূলকভাবে কম বয়সে। বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণায় এটা স্বীকৃত যে মানসিক রোগগুলোর অন্তত ৫০ শতাংশ শুরু হয় ১৪ বছর বয়সের আগেই। আর ৭৫ শতাংশ সমস্যা শুরু হয় ২৪ বছর বয়সের আগে। তার মানে মানসিক স্বাস্থ্য বা মানসিক রোগ বিবেচনায় তরুণ বা শিশু-কিশোর বয়স খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই দেখা যায়, তরুণদের এমনিতেই মানসিক রোগের ঝুঁকি বেশি। তার ওপর জুলাইয়ের মতো একটি প্রলয় যখন মনের ওপর দিয়ে বয়ে যায়, তার প্রভাব যে বহুদিন থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।
হতাহতের সংখ্যা ও ধরন-প্রকৃতি বিবেচনায় মানসিক স্বাস্থ্য অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। জীবন তো আর থেমে থাকবে না। সামনে যেতে হবে, চলতে হবে, জীবন চলবে। এমন একটা প্রতিকূল বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি ঠিক যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে কি?
মনে রাখতে হবে, আন্দোলনকারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আন্দোলনের ফলাফলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। ব্যাপারটা আসলে এমন নয় যে আন্দোলনে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ হলো, তাই কোনো মানসিক সমস্যা হবে না।
হারজিতের সঙ্গে সরাসরি মানসিক রোগ বা সমস্যার কোনো সম্পর্ক নেই। এমন ঘটনার পর শারীরিক বা মানসিক—দুই ধরনের সমস্যাই হতে পারে।
আমরা এটা ভালো করেই জানি, মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের সমাজে এখনো অবহেলিত। যে কারণেই হোক, যেভাবেই হোক, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সরাসরি চিকিৎসা চাইবে বা চিকিৎসার বিষয়ে কথা বলবে, এখনো সেটা আশা করা বাতুলতা। তার ওপর আমরা যে বয়সের মানুষগুলোর কথা আলাপ করছি, তারা এমনিতেই নিজেদের শরীর-স্বাস্থ্যের কথা পরিবার বা ডাক্তারের কাছে কমই বলতে চায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মা-বাবা বা অভিভাবকেরাই কিছুটা আঁচ করতে পারেন কোনো একটা সমস্যা হলে। জিজ্ঞেস করেন, কী হয়েছে? কেন হয়েছে? বা কোনো সমস্যা কি হয়েছে?
অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিভাবকেরাই চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেন। আর এমন একটা আন্দোলনের পর তারা নিজেরা নিজেদের সমস্যার কথা বলবে, সেটা আশা করা কিন্তু বোকামি। সরাসরি আহত হওয়ার পাশাপাশি কাছের মানুষ কিংবা বন্ধুবান্ধবের মৃত্যু কিংবা আহত হওয়াও কিন্তু মনে প্রচণ্ড আঘাত আনতে পারে। শুধু ছবি বা ভিডিও দেখেও মনে আঘাত লাগতে পারে, একটা গভীর ট্রমা বা অ্যাকিউট স্ট্রেস হিসেবে কাজ করতে পারে। আবার আন্দোলন–পরবর্তী অনেক ঘটনাপ্রবাহ মনঃপুত না হওয়া হতাশা ডেকে আনতে পারে।
তাই আমরা যারা অভিভাবক, তার কি এ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে অনুভব করতে পারছি? আমরা কি খোঁজ নিচ্ছি মনের ভেতরে বয়ে যাওয়া অনুভবগুলো?
কীভাবে মনের খবর নেবেন?
যারা সরাসরি আন্দোলনে জড়িত ছিল বা নানাভাবে আহত, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশনে ভুগছে, ৫৪ শতাংশ ভুগছে উদ্বেগজনিত সমস্যায়—সম্প্রতি একটি জরিপে এটি প্রকাশিত হয়েছে। আবার যারা সরাসরি জড়িত ছিল না, তাদের মধ্যেও অস্থিরতা ও মানসিক চাপ বেড়েছে। মোট ছয় ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে এ ধরনের আন্দোলনের পর।
১. তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার ও দীর্ঘ মেয়াদে পোস্ট–ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, ২. ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা, ৩. উদ্বেগ বা অ্যাংজাইটি, ৪. ঘুমের সমস্যা ও দুঃস্বপ্ন, ৫. মনোযোগের সমস্যা, ৬. হতাশা ও অপরাধবোধ।
আপনার সন্তানটি এ ধরনের কোনো সমস্যায় ভুগে থাকলে সে বিষয়ে সচেতন হোন। প্রয়োজনে মনোবিদের সাহায্য নিন। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী কিশোর–তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যে দিকগুলো বিবেচনায় আনা উচিত—
সচেতনতা: সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখুন। এ বিষয়ে সচেতন হোন। তার ঘুম, খাওয়ার রুটিন, পড়াশোনার দিকে যত্ন নিন।
মানসিক সাপোর্ট: কেউ হয়তো প্রিয় বন্ধুকে হারিয়েছে, কারও হয়তো একাডেমিক বা অন্য কোনো দিকে ক্ষতি হয়েছে, কারও পরিবার অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বাড়িঘরের ক্ষতি হয়েছে। এসব ক্ষতি সামাল দিতে পাশে থাকুন। সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট দিন। খারাপ দিন পেরিয়ে ভালো দিন আসবে—এমন আশ্বাস দিন।
প্রাথমিক প্রতিরোধ: শুরুতে ব্যবস্থা নিলে অনেকটাই ক্ষতি সামলে ওঠা সম্ভব। সমস্যা তীব্র মনে হলে দ্বিধা না করে অল্প থাকতেই ব্যবস্থা বা সাহায্য নিন।
সমন্বিত ব্যবস্থা: এই সমস্যার মোকাবিলা করতে সমন্বিত ব্যবস্থা প্রয়োজন। সরকারি, বেসরকারি সংস্থা, পরিবার, সমাজ সবাই মিলে কাজ করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: এ সময়ের তারুণ্যের এই অভিঘাত ও দ্বন্দ্ব মেটাতে এবং এর প্রভাব সামাল দিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। লেখাপড়ার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, কিশোর-তরুণদের হতাশা, বিষণ্নতা ও স্ট্রেস মোকাবিলা করার জন্য অভিভাবক–শিক্ষকদের সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ এবং ইতিবাচক পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
অধ্যাপক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার, চেয়ারম্যান, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা