পাহাড়ে প্রথম নারী ব্যারিস্টার

ভ্যালী চাকমা
ছবি: সংগৃহীত

উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন ভ্যালী চাকমা। কিন্তু বাবার ইচ্ছা ছিল মেয়ে আইন পড়ুক। বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে স্নাতকে গিয়ে আইনকেই পড়াশোনার বিষয় হিসেবে বেছে নেন ভ্যালী। সেখানেই থেমে থাকেননি। গত বছরের নভেম্বরে লন্ডনের অনারেবল সোসাইটি অব লিংকনস ইন থেকে অর্জন করেছেন বার-অ্যাট-ল। ভ্যালী চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম তো বটেই, সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে প্রথম নারী, যিনি ব্যারিস্টার হলেন।

আরও পড়ুন

রাঙামাটির লংগদুতে ভ্যালীদের গ্রামীর বাড়ি। বাবা কল্যাণ মিত্র চাকমা ও মা অনুভা চাকমার দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে ভ্যালী দ্বিতীয়। বাবার সরকারি চাকরির সূত্রে পাহাড় থেকে দূরে দূরে কেটেছে তাঁর ছোটবেলা। খুলনার সরকারি করনেশন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন ভ্যালী। এরপর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বালিকা বিদ্যালয়। সেখান থেকেই ২০০৬ সালে এসএসসি আর ২০০৮ সালে চট্টগ্রামের সরকারি কমার্স কলেজ থেকে করেন উচ্চমাধ্যমিক। এরপর ভূঁইয়া একাডেমি থেকে আইনে স্নাতক হন। কিন্তু এরপর আরও পথ চলা বাকি ছিল। ভ্যালীর বাবা কল্যাণ মিত্র চাকমা বলেন,‘চেয়েছিলাম মেয়ে যে বিষয়ে পড়ছে, তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাক। তাই ওর পাশে থেকেছি, যতটা পারি সহযোগিতা করেছি।’ তাই খুলনা, চট্টগ্রাম, ঢাকা হয়ে একেবারে লন্ডন। সেখান থেকে বার-অ্যাট-ল করে এখন সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করছেন ভ্যালী।

লন্ডন থেকে বার-অ্যাট-ল করে এখন সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করছেন ভ্যালী
ছবি: সংগৃহীত

বাণিজ্য বিভাগে পড়ার সময় আইনজীবী হওয়ার কথা ভাবেননি ভ্যালী, ‘বাবার ইচ্ছাতেই আইন বিষয়ে পড়েছি। তবে পড়তে গিয়ে এ বিষয়টাকে ভালোবেসে ফেলেছি। পড়া আমার শেষ হয়নি, হবেও না। সারা জীবন পড়তে চাই। আসলে শিক্ষা তো সারা জীবন ধরেই নিতে হয়।’

বরাবরই লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন ভ্যালী। কঠোর পরিশ্রমই সাফল্যের কারণ, মনে করেন তিনি। তবে একজন পাহাড়ি ও মেয়ে হয়ে এতটা পথ আসতে অনেক কষ্টই করতে হয়েছে। সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। ভ্যালী বলেন, ‘যখন স্কুলে ভালো ফল করেছি, কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি, বাব্বা, চাকমা মেয়ে এই রেজাল্ট
করেছে। ধরেই নেওয়া হতো আমরা পাহাড়িরা কোটায় পড়ার সুযোগ পাই, তাই ভালো ফল করা আমাদের জন্য স্বাভাবিক নয়। তবে এটুকু বলি, কখনো কোটার সুযোগ নিইনি। যোগ্যতার বলেই সাফল্য পেয়েছি।’

যুক্তরাজ্যের ক্যাম্পাসে
ছবি: সংগৃহীত

আদালতে প্র্যাকটিস করতে গিয়েও পাহাড়ি হওয়ার ‘দায়ে’ কথা শুনতে হয়েছে। আদালতে পাহাড়ি হয়ে কত দিন টিকতে পারবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

ভ্যালীর কথা, ‘এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা যেমন আছে, মানুষের সহযোগিতার অনেক উদাহরণও তেমন আছে। সমাজে ভিন্ন জাতিসত্তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আরও উন্নত হবে, সেই প্রত্যাশা করি।’

ভ্যালী যে অঞ্চলের মানুষ, সেই রাঙামাটির চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায় নিজেও ব্যারিস্টার। পাহাড়িদের মধ্যে প্রথম ব্যারিস্টার। তাঁর পরেই ব্যারিস্টার হলেন ভ্যালী। সেই অর্থে ভ্যালী পাহাড়ের নারীদের মধ্যে প্রথম এবং নারী–পুরুষ সবার মধ্যে দ্বিতীয় ব্যারিস্টার। ভ্যালীর এ সাফল্যে খুব খুশি রাজা দেবাশীষ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা শুধু আয়রোজগারের পথ নয়। আইনের মৌল বিষয়গুলো একজন বার-অ্যাট-ল আইনজীবীকে শক্ত ভিত্তি তৈরি করে দেয়। আমি চাই, ভ্যালী সেই প্রজ্ঞা মানুষের, বিশেষ করে পাহাড়ের মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাক।’ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় ভিন্নতা আছে। এসব ভিন্নতা পাহাড়কে এক স্বকীয়তা দিয়েছে। রাজা দেবাশীষের আশা, এসব নিয়ম ও রীতি নিয়ে ভ্যালীও সজাগ। আর এসব নিয়ে তিনি কাজও করবেন।

ভ্যালীর ইচ্ছা, তাঁর পেশা মানুষের মঙ্গলে কাজে লাগুক। বিশেষ করে সেই সব মানুষের, যাঁরা অসহায়।