উড়োজাহাজের জানালায় ছিদ্র থাকে কেন

জানালার নিচের দিকের এই ছিদ্র কেবল নকশার কারণে রাখা হয় নাছবি: পেক্সেলস

উড়োজাহাজ ভ্রমণে বেশির ভাগেরই জানালার পাশের আসনটি পছন্দ। ভ্রমণকালে উড়োজাহাজের জানালায় একটু মনোযোগ দিলে আপনারও চোখে পড়বে ছোট্ট একটি ছিদ্র। একে বলে ‘ব্লিড হোল’ বা ‘ব্রিদার হোল’। কিন্তু কেন থাকে এই ছিদ্র?

জানালার নিচের দিকের এই ছিদ্র কেবল নকশার কারণে রাখা হয় না। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে উড়োজাহাজের নিরাপত্তাও। উড়োজাহাজের ভেতরে ও বাইরে বায়ুর চাপ থাকে আলাদা। যাত্রীদের কেবিনের ভেতরে বায়ুর চাপ বেশি এবং বাইরে কম।

ফলে উড়োজাহাজের জানালাকে অনেক চাপ সহ্য করতে হয়। আর এটা জানালার নকশা করার সময় মাথায় রাখা হয়। জানালার এই ছিদ্র বায়ুর চাপ নিয়ন্ত্রণ করে।

উড়োজাহাজের জানালাগুলো অ্যাক্রিলিকের তিনটি স্তর দিয়ে তৈরি। কেবিনের দিক থেকে প্রথম স্তরটি ময়লা এবং দাগ থেকে যাত্রীকে সুরক্ষা দেয়। এরপর থাকে মাঝের স্তর। এই স্তরেই থাকে ব্রিদার হোল। সবশেষে থাকে বাইরের স্তর। এই স্তরটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, এটাকেই বাতাসের চাপ সবচেয়ে বেশি সহ্য করতে হয়। বাইরের এবং মাঝের স্তরটির মধ্যবর্তী জায়গা বাতাসে পূর্ণ থাকে।

ব্রিদার হোলের কাজকে প্রকৌশলীরা হাতুড়ির সঙ্গে তুলনা করেন। হাতুড়ি যেমন সজোরে ফেললে বেশি আঘাত লাগে এবং ধীরে ফেললে কম, এটিও তেমন। ছোট ছিদ্রটির কারণে বাতাসের চাপ সজোরে জানালার বাইরের স্তরে আঘাত করে না। এটি ধীরে ধীরে চাপ ছড়িয়ে দেয়, ফলে চাপের প্রভাব কমে যায়।

আরও পড়ুন

আবার ছিদ্রটি উড়োজাহাজের বাইরের দৃশ্য উপভোগের জন্যও জরুরি। অধিক উচ্চতায় উড়োজাহাজের বাইরের আবহাওয়া থাকে অত্যধিক শীতল। ফলে জানালার কাচটিও ঠান্ডা হয়ে যায়। ভেতরে যাত্রীদের নিশ্বাসের আর্দ্রতা (বাতাসে থাকা জলীয় বাষ্পের পরিমাণ) ঠান্ডা কাচের সংস্পর্শে এসে পানির ফোঁটা তৈরি করতে পারে। ছিদ্রটি থাকায় জানালার কাচে এই পানির ফোঁটা তৈরি হয় না। ফলে জানালা ঝাপসা হওয়া থেকে রক্ষা পায় এবং আপনি বাইরের পরিষ্কার দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।

ছিদ্র না থাকলে কী হতো

ছিদ্রগুলো না থাকলে উড়োজাহাজের জানালার কাচ ঘোলা হয়ে যেত
ছবি: পেক্সেলস

ছিদ্রগুলো না থাকলে উড়োজাহাজের জানালার কাচ ঘোলা হয়ে যেত। এটি কেবল বাইরের দৃশ্য উপভোগে ব্যাঘাত ঘটাত না বরং নিরাপত্তাঝুঁকিও তৈরি করত। জরুরি অবস্থায় যাত্রীদের বাইরের অবস্থা দেখা সম্ভব হতো না। অন্যদিকে উদ্ধারকারীরাও ভেতরের অবস্থা বুঝতে পারতেন না। এ ছাড়া বারবার সজোরে বাতাসের চাপ লাগার ফলে জানালার কাচের সিল (বায়ুরোধী ব্যবস্থা) দ্রুত নষ্ট হয়ে যেত।

কবে থেকে জানালায় ছিদ্র রাখা হয়

শুরু থেকে উড়োজাহাজের জানালায় এমন ছিদ্র ছিল না। পুরোনো উড়োজাহাজগুলো কম উচ্চতায় উড়ত। সেখানে পর্যাপ্ত বাতাসের চাপের তেমন তারতম্য হতো না। ফলে এই ছিদ্রের দরকার হতো না।

১৯৪০ সালে অধিক উচ্চতায় উড়তে পারা উড়োজাহাজ আসতে থাকে। ফলে বাতাসের চাপ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম, এমন কেবিনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বোয়িং ৩০৭ স্ট্র্যাটোলাইনার প্রথমবারের মতো কেবিন প্রেশারাইজেশন প্রযুক্তি বা কেবিনে বাতাসের চাপ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম কেবিন নিয়ে আসে।

প্রকৌশলীরা একটি সমস্যার সমাধানে গোলাকার জানালা নিয়ে আসেন এবং তাতে ছিদ্র রাখেন
ছবি: পেক্সেলস

১৯৫০ সালের দিকে দ্য হ্যাভিল্যান্ড কোমেট উড়োজাহাজগুলো পরপর দুর্ঘটনার শিকার হয়। তদন্তে দেখা যায়, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী উড়োজাহাজগুলোর চারকোনা জানালা। জানালার কোনাগুলোয় বারবার বাতাসের চাপ লেগে ধাতব স্তরে দুর্বল হয়ে পড়ত। একসময় যা ফেটে গিয়ে ঘটত দুর্ঘটনা। প্রকৌশলীরা এই সমস্যার সমাধানে গোলাকার জানালা নিয়ে আসেন এবং তাতে ছিদ্র রাখেন। এতে বাতাসের চাপের প্রভাব কমে গিয়ে দুর্ঘটনাও বন্ধ হয়।
এই ছোট পরিবর্তনটি উড়োজাহাজ ভ্রমণকে করেছে আরও নিরাপদ।

সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট

আরও পড়ুন