গবেষণা নিয়েও যে ‘উৎসব’ হতে পারে, দেখিয়ে দিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীরা
সকালেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনের সামনে ভিড়। কেউ প্রেজেন্টেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কেউ অন্য গবেষকের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন, কেউবা তখন ছবি তুলতে ব্যস্ত। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি এডুকেশন ক্লাব (আরইউইসি) আয়োজিত ‘আরইউইসি ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ কনফারেন্স ২০২৫’-এর পরিবেশ ছিল এমনই উৎসবমুখর।
৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর—দুদিনব্যাপী আয়োজিত হলো ‘আরইউইসি ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ কনফারেন্স ২০২৫’। আয়োজনে ছিল পোস্টার প্রেজেন্টেশন, ওরাল প্রেজেন্টেশন, থ্রি মিনিট থিসিস, প্যানেল ডিসকাশন, কর্মশালা, একক বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজন। ‘অ্যাডভান্সিং নলেজ অ্যান্ড ইনোভেশন অ্যাক্রস ডিসিপ্লিনস ফর সোশ্যাল ট্রান্সফরমেশন’ এই ছিল সম্মেলনের মূল বিষয়। অর্থাৎ সমাজবদলের জন্য বিভিন্ন বিভাগ এক হয়ে জ্ঞান ও উদ্ভাবনকে এগিয়ে নেওয়া। গবেষণা সম্মেলনটির অন্যতম সহযোগী ছিল প্রথম আলো।
আয়োজক একঝাঁক তরুণ
বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল উদ্যমী তরুণের সংগঠন রাজশাহী ইউনিভার্সিটি এডুকেশন ক্লাব। এই সংগঠনের সদস্যদেরই নির্ঘুম রাতের ফসল এই সম্মেলন। মূল বিষয়বস্তু কী হবে, অনুষ্ঠানে কী কী থাকবে, অতিথি কারা হবেন, ভেন্যু কী হবে, এসব নিয়ে আলোচনা চলেছে দিনের পর দিন। বৈজ্ঞানিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ, কনফারেন্স কিট নির্ধারণ, আগত অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা—কত কাজ! ১০টি দেশ থেকে এক শর বেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা সম্মেলনের জন্য প্রায় ১ হাজার ৬০০ ‘গবেষণা সারসংক্ষেপ’ জমা দিয়েছিলেন। সেখান থেকে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে নির্বাচিত হয় ৩৮০টি। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬৩ জন শিক্ষকের বৈজ্ঞানিক কমিটি গবেষণা সারসংক্ষেপ নির্বাচন করে।
এডুকেশন ক্লাবের বর্তমান সভাপতি ও সম্মেলনের আহ্বায়ক রায়হানা মালিক বলেন, ‘আমাদের এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল এমন একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যেখানে দেশ-বিদেশের তরুণ গবেষক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এক হয়ে জ্ঞান বিনিময় করতে পারবেন। নতুন প্রজন্ম গবেষণার প্রতি উৎসাহী হবে। আমরা তাঁদের চিন্তার স্বাধীনতাকে একটা জায়গা করে দিতে পেরেছি, এটাই আমাদের সার্থকতা।’
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হচ্ছে এখানে কম জায়গার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মস্তিষ্ক থাকে। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ২৫০টির বেশি। এই শক্তিকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। আর সেটার জন্য প্রয়োজন মস্তিষ্কের অনুশীলন, যা গবেষণার মাধ্যমে সম্ভব।মোহাম্মদ কায়কোবাদ, শিক্ষাবিদ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
আলোচনা, কর্মশালা, বক্তৃতা
সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ। এ ছাড়া প্রথম দিনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল প্যানেল ডিসকাশন। ‘শেপিং দ্য ফিউচার: রিসার্চ ফর অল সোশ্যাল ট্রান্সফরমেশন ইন ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্লোবাল কনটেক্সট’ শিরোনামের আলোচনায় অংশ নেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাসির উদ্দিন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বায়োমেডিকেল প্রকৌশল বিভাগের প্রধান মুহাম্মদ তারিক আরাফাত ও বাংলাদেশ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টারের মেম্বার ডিরেক্টিং স্টাফ (এমডিএস) মো. জহুরুল ইসলাম। আলোচনায় অধ্যাপক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা চাই বা না চাই, সমাজের রূপান্তর থেমে থাকবে না। একজন গবেষক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব দর্শক হিসেবে সেটিকে উপভোগ করা নয়, বরং সেই রূপান্তরকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করা।’
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে বহুল প্রতীক্ষিত কর্মশালা ঘিরেই ছিল সবার আগ্রহ। সকাল ৯টায় অনলাইনের মাধ্যমে যুক্ত হন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক রোজমেরি এভান্স। তিনি ‘রিসার্চ ভিজিবিলিটি অ্যান্ড একাডেমিক ব্র্যান্ডিং থ্রু ডিজিটাল মিডিয়া’ বিষয়ের ওপর এক ঘণ্টার একটি কর্মশালা পরিচালনা করেন। এরপর সম্মেলনে উপস্থিত গবেষক ও দর্শনার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। একজন গবেষক কীভাবে একাডেমিক পরিচয় গড়ে তুলবেন, কীভাবে গবেষণার প্রভাবকে আরও বিস্তৃত করবেন, সেটিই উঠে এসেছে তাঁর কথায়।
কর্মশালার পর বক্তব্য দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সালেহ হাসান নকীব। তিনি আলোচনা করেছেন গবেষণার নৈতিকতা বিষয়ে। গবেষণা মানেই যে শুধু একটি বিষয়ের বিশ্লেষণ নয়; বরং এর সঙ্গে নৈতিকতার নানা দিকও জড়িত, তা বর্ণনা করেছেন তিনি।
যদিও গবেষণায় অনৈতিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। কিন্তু এটা একেবারেই উচিত নয়। গবেষণাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে গবেষককে অবশ্যই নৈতিকতার পথ অবলম্বন করতে হবে। গবেষণাপদ্ধতি, বিশ্লেষণ, প্রকাশনাসহ প্রতিটি ধাপে গবেষককে সৎ থাকতে হবে।সালেহ হাসান নকীব, উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সময় মাত্র ৩ মিনিট
থ্রিএমটি (থ্রি মিনিট থিসিস) হলো একধরনের একাডেমিক প্রতিযোগিতা, যেখানে গবেষকেরা তাঁদের পুরো গবেষণাকর্ম মাত্র তিন মিনিটে উপস্থাপন করেন। সাধারণত মাস্টার্স বা পিএইচডি পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাই এতে অংশ নেন। সম্মেলনের এই সেগমেন্টে চ্যাম্পিয়ন হন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. তৌফিক হাসান। শুধু থ্রি মিনিট থিসিস নয়, দুই দিনের এই আয়োজনে প্রেজেন্টেশন হয়েছে আরও দুই ক্যাটাগরিতে। ওরাল প্রেজেন্টেশনে উপস্থাপন করা হয় ২৫০টি গবেষণাপত্র। পোস্টার প্রেজেন্টেশনে ১০০টি।
দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্টার প্রেজেন্টেশন দিতে আসেন মো. হেলাল উদ্দিন। হেলাল বলেন, ‘আমার চিন্তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু পেয়েছি। বিশেষ করে সম্মেলনে প্রেজেন্টেশনের বাইরে কর্মশালা, আলোচনা ও নেটওয়ার্কিংয়ের বিষয়গুলো অনেক বেশি উপভোগ করেছি।’
এ ছাড়া আলাদাভাবে নজর কেড়েছে ‘গবেষণা মেলা’। মেলায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ তাদের নিজস্ব গবেষণা ও প্রকাশনা তুলে ধরে।
বিদেশি অংশগ্রহণকারী
সম্মেলনটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে বিদেশি গবেষকদের অংশগ্রহণ। পাকিস্তান, নেপাল, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পাঁচ দেশের ১০ জন বিদেশি গবেষক তাঁদের গবেষণা উপস্থাপন করেছেন। সেরা উপস্থাপনার জন্য পুরস্কারও পেয়েছেন কেউ কেউ। ‘কলা, সংস্কৃতি ও মানবিক’ সাব থিমে সেরা ওরাল প্রেজেন্টেশনের (মৌখিক উপস্থাপন) পুরস্কার পেয়েছেন নেপালের বাগিশ্বরী কলেজের প্রভাষক রাজন ফেলু। ‘ব্যবসা, ব্যবস্থাপনা ও উদ্ভাবন’ সাব থিমে সেরা মৌখিক উপস্থাপকের পুরস্কার পেয়েছেন নেপালি শিক্ষক পিতাম্বর সাপকোটা ও সন্দীপ পাউডেল।
রাজন ফেলু বলেন, ‘আয়োজকদের আতিথেয়তা থেকে শুরু করে প্রতিটি ইভেন্টই বেশ উপভোগ্য ছিল। কিন্তু যখন পুরস্কার পেয়েছি, সে মুহূর্তটা একটু বেশি স্পেশাল। ধন্যবাদ বাংলাদেশ সুন্দর কিছু স্মৃতি উপহার দেওয়ার জন্য।’
ছিলেন নিবন্ধিত দর্শনার্থী
যাঁরা গবেষণা শিখছেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের সম্মেলনে নিজের কাজ উপস্থাপনে আগ্রহী; তাঁদের জন্যও সুযোগ ছিল। সারা দেশের ৮০টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০০ নিবন্ধিত দর্শনার্থী সম্মেলনে অংশ নেন। তাঁরা পুরো আয়োজনটি উপভোগ করেছেন। প্রতিটি সেশন শুনেছেন মনোযোগ দিয়ে। গবেষক ও সংগঠকদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনাও করেছেন। দেশি-বিদেশি গবেষকেরা উপস্থিত থাকায় এই সম্মেলন তাঁদের জন্য ছিল নেটওয়ার্কিংয়ের বড় সুযোগ। গবেষণা তো শুধু করলেই হয় না; কীভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপন করতে হয়, কীভাবে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়—এসব সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন নবীন গবেষকেরা।
ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে এসেছিলেন তাসনিম তাহের। বললেন, ‘এখানে এসে বুঝেছি, গবেষণা শুধু বই বা প্রবন্ধের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। বরং মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় আর অভিজ্ঞতা ভাগ করার মধ্যেই এর আসল সৌন্দর্য। আমি শিখেছি, প্রতিটি ভাবনা তখনই শক্তিশালী হয়, যখন আমরা সেটি অন্যের সামনে তুলে ধরি এবং তাঁদের মতামত শুনি। নিজেকে গবেষক হিসেবে প্রস্তুত করার অনুপ্রেরণা পেয়েছি।’
এভাবেই গবেষণার প্রতি আরও বহু তরুণকে অনুপ্রাণিত করতে চায় রাজশাহী ইউনিভার্সিটি এডুকেশন ক্লাব। ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্মেলনের সভাপতি ফুয়াদ পাবলো বলেন, ‘আমরা এই সম্মেলন নিয়মিত আয়োজন করে যেতে চাই। তরুণ গবেষকেরা যেন শুধু নতুন গবেষণা উপস্থাপনই নয়, বরং সামাজিক পরিবর্তন এবং সমাজে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগও পান। আমাদের লক্ষ্য, অংশগ্রহণকারীরা যেন গবেষণার মাধ্যমে সমকালীন সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানের উপায় খুঁজতে উৎসাহিত হন।’
ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আনজুম তাসনিম বলেন, ‘আমরা লক্ষ করেছি, অংশগ্রহণকারীরা কেবল জ্ঞান অর্জন করছেন না, বরং নিজ চিন্তাভাবনার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলার উদ্দীপনা পাচ্ছেন। সে রকম একটা প্ল্যাটফর্ম যে আমরা করে দিতে পেরেছি, এটাই বড় আনন্দ।’