অর্ণব–সুনিধির ভালোবাসা, তারপর...

শায়ান চৌধুরী অর্ণব আর সুনিধি নায়েক—নবদম্পতির সঙ্গে কথা হচ্ছিল গত সোমবার দুপুরে। ঘুরেফিরে নানা প্রশ্নে আমরা জানতে চেষ্টা করছিলাম, কেমন করে দুজনের বন্ধুত্ব হলো? কীভাবে হলো প্রেম, বিয়ে?

গান, আড্ডা আর খুনসুটিতে চলছে অর্ণব–সুনিধির সংসারছবি: সুমন ইউসুফ

কখনো কখনো কথার চেয়ে গানের শক্তি বেশি। আড্ডা যদি জমে দুজন সংগীতশিল্পীর সঙ্গে, তাহলে তো বটেই। শায়ান চৌধুরী অর্ণব আর সুনিধি নায়েক—নবদম্পতির সঙ্গে কথা হচ্ছিল গত সোমবার দুপুরে। ঘুরেফিরে নানা প্রশ্নে আমরা জানতে চেষ্টা করছিলাম, কেমন করে দুজনের বন্ধুত্ব হলো? কীভাবে হলো প্রেম, বিয়ে? পুরো আলাপের শেষে যখন দুজন দুটি গান শোনালেন, মনে হলো কী আশ্চর্য! সব কথা তো গানেই বলা আছে।

কী গান গেয়েছিলেন দুজন? বলছি পরে। অতি আগ্রহী পাঠক চাইলে এই লেখার শেষ অংশ থেকে ঘুরে আসতে পারেন।

বন্ধু রহো সাথে

সুনিধির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীতে স্নাতকোত্তর। অর্ণব ঢাকার ছেলে হলেও শান্তিনিকেতন তাঁর প্রাণ। ছেলেবেলা-বড়বেলা মিলিয়ে সেখানে থেকেছেন দীর্ঘদিন। ঢাকাকে ‘এই শহর আমার’ বলা অর্ণব যে বছর কয়েক পরপর শান্তিনিকেতনে ‘ডুব’ দেন, সেটা তাঁর ভক্তদের জানা।

বছর দুই আগে ওই ‘ডুব’ দিতে গিয়েই সুনিধির সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, প্রেম, বিয়ে। সম্পর্কের তিন স্তরে কি দুজন তিনটি আলাদা মানুষকে আবিষ্কার করেছেন, নাকি সব সময় একটা মানুষই মনে হয়েছে?

সুনিধি বললেন, ‘একই তো। আগে বন্ধু ছিলাম, এখনো বন্ধু।’

কথার প্রমাণ মিলল সঙ্গে সঙ্গেই। অর্ণব পাশ থেকে ফোড়ন কাটলেন, ‘আগে ওর নাকটা একটু উঁচু ছিল। এখন আস্তে আস্তে নামছে।’

‘মোটেই না!’ সুনিধির প্রতিবাদ।

খুনসুটি চলছিল আড্ডাজুড়েই। মুহম্মদ জাফর ইকবালের গল্প থেকে চলচ্চিত্র বানানোর ইচ্ছা অর্ণবের, এ প্রসঙ্গ উঠতেই সুনিধি যেমন বলছিলেন, ‘আমার ঘরে সারা দিন ক্যাপ্টেন আমেরিকা নয়তো আয়রনম্যান চলে।’ অর্ণব বললেন, ‘তুমি যে সারা দিন ভ্যাম্পায়ার নয়তো জম্বির সিনেমা দেখো, সেটা?’ ক্যাপ্টেন আমেরিকা আর জম্বির লড়াইয়ে জয় হয় কার? এ প্রশ্নে অবশ্য দুজন আঙুল তুললেন দুজনের দিকে।

বন্ধুত্ব তো বোঝা গেল। কিন্তু কে আগে বলেছিলেন, ‘বন্ধু রহো সাথে?’ ব্যাখ্যা করলেন অর্ণব, ‘আমরা দুজন দুজনের সঙ্গটা উপভোগ করছিলাম। ও ভালো গান গায়, আমি গিটার বাজাই। ও আমার কাছ থেকে শিখছে, আমি ওর কাছ থেকে শিখছি। এরপর একটা সময় এল, মানসিকভাবে দুজনের খুব সুন্দর একটা সামঞ্জস্য হলো। আমার মন খারাপ লাগলে ও পাশে থাকে, ওর মন খারাপের সময় আমি থাকি পাশে। শান্তিনিকেতনের পরিবেশও দুজনের বোঝাপড়া আরও মজবুত করেছে।’

এবার অবশ্য সুনিধি দ্বিমত করলেন না। তাই বলে ফোড়ন কাটার সুযোগটাও ছাড়লেন না, ‘খুব সুন্দর বললে তো তুমি!’ বলেই সঙ্গে যোগ করলেন, ‘এই প্রথম!’

ভালোবাসা তারপর দিতে পারে গত বর্ষার সুবাস...
ছবি: সুমন ইউসুফ

হারিয়ে যাইনি তবু...

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বারবার ঘুরেফিরে আসে দুজনের গল্পে-গানে। তাই রবিঠাকুরের লেখা বিবিধ প্রসঙ্গ বইয়ের ‘বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা’ থেকে কিছু অংশ মনে করিয়ে দিই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদার্থ বুঝায়। দুই জন ব্যক্তি ও একটি জগৎ। অর্থাৎ দুই জনে সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা। আর, প্রেম বলিলে দুই জন ব্যক্তি মাত্র বুঝায়, আর জগৎ নাই। দুই জনেই দুই জনের জগৎ।’

অর্ণব-সুনিধি কি একমত? অর্ণব বললেন, ‘আমার যে একটা জগৎ ছিল না, তা নয়। আমি সেই জগতের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু সুনিধির বন্ধুত্ব আমাকে শক্তি দিয়েছে।’ ভক্তরা জানেন, বছর কয়েক পরপরই অর্ণবের ‘মন বসে না গানের টেবিলে’। গান থেকে বিরতি নিয়ে কখনো ছবি এঁকে, কখনো অ্যানিমেশন তৈরি করে তিনি বলতে চেষ্টা করেন, ‘হারিয়ে যাইনি তবু, এটাই জরুরি খবর’। মানসিকভাবে অর্ণব অনেকটা থিতু হয়েছেন, আবারও পুরোদমে গান করছেন, এখন জরুরি খবর এটাই। কাজে স্থিরতা খুঁজে পাওয়ার কৃতিত্বও দিলেন সুনিধিকে।

পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে অর্ণব-সুনিধির বিয়ে হয়েছে গত ২৮ অক্টোবর। এখন সম্পর্কের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা কাটছে, একমত হলেন দুজনই। অর্ণব বলছিলেন, ‘বিয়ের আগের রাত থেকে সুনিধির হঠাৎ শরীর খারাপ লাগছিল। যেমনটা হয়—বুক ধড়ফড় করা, পেটের ভেতর গুড় গুড় করা। যাকে বলে “বাটারফ্লাই ইন দ্য স্টমাক”। সই করার সঙ্গে সঙ্গে ও পুরোপুরি ঠিক হয়ে গেল। আর এই সব অনুভূতি এসে ভর করল আমার ওপর!’

কথাটা যে মজা করে বলা, দুজনের হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ‘হারিয়ে গিয়েছি’ নয়, ‘শীতের সন্ধ্যায় আমার তোমার কি কোথাও হারিয়ে যাওয়ার কথা’ গানটিই অর্ণবের এখনকার সময়ের সঙ্গে বেশি মানানসই।

গানে আর সুরে চলছে নতুন দম্পতির সংসার।
ছবি: সুমন ইউসুফ

ভালোবাসা তাই অন্য কোথাও

সুনিধি বলছিলেন, গায়ক অর্ণব নন, ব্যক্তি অর্ণবের সঙ্গেই তাঁর আগে পরিচয়। তারকা অর্ণবকে চিনেছেন আরও পরে। গত বছর বাংলাদেশে অর্ণবের সঙ্গে একই মঞ্চে গান করেছেন। কনসার্টে হাজির হওয়া মানুষের রোমাঞ্চ, আবেগ দেখে চেনা বন্ধুর দিকেই তাকিয়েছেন নতুন করে।

গায়ক অর্ণব, তারকা অর্ণব—সে তো আমাদেরও চেনা। ‘প্রেমিক’ অর্ণব কেমন? সুনিধি একটা গল্প শোনালেন, ‘লকডাউনের সময় ঘরে কোনো কাজের লোক আসছিল না। আমাকেই সবকিছু করতে হচ্ছিল। অর্ণবের তো একটা অজুহাত আছে—এটা করতে পারি না, ওটা করতে পারি না। একদিন আমি রান্না করছি। দেখি, হঠাৎ ও কোথায় যেন গেল। আমাদের অনেক বড় একটা বাগান আছে শান্তিনিকেতনে। কোথা থেকে একটা গাছের শিকড়বাকড় তুলে একটা আংটি বানিয়ে বলল, এটা তোমার জন্য।’

অর্ণবের ‘তোমার জন্য’ গানটি দিয়েই আড্ডা শেষ হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু সুনিধি আগেই বলেছেন, ডুব অ্যালবামের ‘চাই’ গানটা তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। অতএব অর্ণব শোনালেন—

‘একটা একটা এলোমেলো পায়ে

একটু একটু তোমার কাছেই যাওয়া

একটা-দুটো অচেনা কথার মোড়ে

একটু একটু তোমায় খুঁজে পাওয়া...’

সুনিধির কাছেই–বা একটা গান না শুনি কী করে? অর্ণবের অনুরোধে সুনিধি শোনালেন একটা নজরুলসংগীত—‘সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে তুমি আমারে ছুঁইয়াছিলে...’।

অর্ণব–সুনিধির গান শুনতে পারেন আপনিও। আড্ডা ও গানের ভিডিও দেখুন এখানে...