অ্যাডামস পিকের ছায়া

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

অ্যাডামস পিক—শ্রীলঙ্কায় যাওয়ার আগে এই একটা জায়গা সম্পর্কেই আমি টুকটাক জানতাম। ইচ্ছা ছিল শ্রীলঙ্কায় গেলে অবশ্যই সেখানে বেড়াতে যাব। কিন্তু আমার ইচ্ছায় রীতিমতো পানি ঢেলে দিল লঙ্কানরা! যাকেই বলি অ্যাডামস পিকে যেতে চাই, সে–ই চোখ সরু করে বলে, ‘পারবে?’ পরে জানতে পারলাম এমন প্রশ্নের কারণ। পাহাড়টা উঁচু। বেশি না, মাত্র ৭ হাজার ৩৫৮ ফুট উঁচু! তার ওপর বর্ষাকাল। প্রায় সারা দিনরাত বৃষ্টি লেগেই থাকে। মেঘের যন্ত্রণায় কিছুই দেখা যায় না। প্রচণ্ড ঠান্ডায় নিউমোনিয়া হয়ে যায় অভিযাত্রীদের, বজ্রপাতে মাঝেমধ্যে দু–একজন মারাও যায় নাকি! কিন্তু এটা ঠিক পর্বতারোহণ নয়; শ্রীলঙ্কানদের কাছে অ্যাডামস পিকে ওঠা মানে তীর্থযাত্রা। মানুষ হিসেবে আমি উদাহরণ দেওয়ার মতো অলস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিক করে ফেললাম, অ্যাডামস পিকে উঠব। শুধু উঠবই না, প্রথা মেনে চূড়ায় রাতও কাটাব। সেখানে সূর্যোদয় দেখা নাকি স্বর্গীয় আনন্দের কাছাকাছি!
কোথাও যাওয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে জায়গাটা নিয়ে যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করা। আমি আমার কোর্সমেট জিন্নাসেনাকে বললাম, ‘কিছু টিপস দাও।’ সে মুখ গম্ভীর করে বলল, ‘তোমাকে মানসিকভাবে মুক্ত থাকতে হবে, না হলে পারবে না। ফ্রি ইয়োর মাইন্ড!’ ম্যাট্রিক্স সিনেমার মরফিয়াস চরিত্রটির মতো দার্শনিকসুলভ উক্তি শুনে আমি উত্তরে ঠিক কী বলব, বুঝতে পারলাম না। বন্ধু আসিরি আর জিন্নাসেনা ঘণ্টা খানেক তর্কাতর্কির পর আমার জন্য রুট ঠিক করে দিল। অ্যাডামস পিকেয় ওঠার ছয়টা রুট আছে। তাদের ভাষায়, তারা আমার জন্য ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ রুটটাই বাছাই করে দিয়েছে। পরে জানতে পেরেছি, আমি ছবি তুলি বলে ওরা অনেক আলোচনা করে সবচেয়ে দীর্ঘ আর সবচেয়ে কঠিন কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর রুটটাই আমার জন্য বাছাই করেছিল।
যাত্রা শুরু করলাম গত ১৫ এপ্রিল সকালে। লোকাল বাসের পূর্বপুরুষদের শাপশাপান্ত করতে করতে পাহাড়ের গোড়ায় পৌঁছালাম সন্ধ্যা ছয়টায়। ততক্ষণে সূর্য পাহাড়ের গায়ে হারিয়ে গেছে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সঙ্গে আছে হু হু ঠান্ডা বাতাস আর বজ্রপাত। পাহাড়ের নিচে বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। পাশেই দেখি দোকানে নানা রকম বৃষ্টিরোধী জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে। একটা রেইনকোট, বিশাল পলিথিন আর ছাতা কিনে উঠতে শুরু করলাম।
কিছুক্ষণ পরে শুনি নিঃশব্দ পাহাড়ে গুমমম গুমমম করে শব্দ! পায়ের নিচে মাটি অল্প অল্প কাঁপছে। চারপাশে অভিযাত্রীরা উঠছে আর মন্ত্র পড়ছে। সময়টা যে কেমন ছিল সেটা কাউকে বোঝানো যাবে না! প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি আর ঘামছি প্রচণ্ড পরিশ্রমে। নিকষ অন্ধকার পাহাড়গুলোয় গুমগুম করে পাহাড়ি জলপ্রপাত নামছে। গুনে দেখলাম ১৩টা। মাঝেমধ্যে চায়ের দোকান, আর বিশাল দীর্ঘ এক পথ। অনেক অনেক দূরে দেখা যায় চূড়া, মেঘের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।
কখনো দমকা হাওয়ার মতো একরাশ মেঘ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে মুখ, চারপাশে সার বেঁধে উঠছে অভিযাত্রীরা। অধিকাংশই মধ্যবয়সী, এমনকি কেউ কেউ বৃদ্ধও! আমার নিজেরই অবস্থা খারাপ, অবাক হলাম লোকগুলোর মানসিক জোর দেখে। বিশ্বাস কতখানি দৃঢ় হলে একজন বৃদ্ধ এই অন্ধকার রাতে সুউচ্চ পাহাড়ে ওঠার দুঃসাহস দেখান। পুরো পথটাই আমার কাছে ভৌতিক লাগছিল। বৃষ্টি, বজ্রপাত, জলপ্রপাত, মন্ত্র আর আলো-আঁধারির খেলা—সব মিলিয়ে স্টিফেন কিংয়ের কোনো উপন্যাসের প্লট!
পুরো পথটাই কাটল স্বপ্নের মতো। কখনো হাঁপিয়ে পড়ি, কখনো মনে হয় আর পারব না! কিন্তু তখনই চোখ পড়ে কোনো মধ্যবয়সী তীর্থযাত্রীর দিকে। কেমন যেন অদ্ভুত জেদ ওঠে। ভালো লাগে একটা ধাপ উঠতে, কোনো সহযাত্রীকে উৎসাহ দিতে। পুরো পথে একমাত্র আমিই ছিলাম, যে একা উঠেছি। আমার সঙ্গে কেউ ছিল না। পরে যে–ই শুনেছে, সে–ই বলেছে এটা পাগলামি! কিন্তু আসলেই আমার সঙ্গে ওঠার মতো কেউ ছিল না। কাউকে তো আর বলা যায় না, ‘ভাই, আসেন, সাত হাজার ফুট এক সঙ্গে ওপরে উঠি।’
যাহোক, একসময় আমরা চূড়ায় পৌঁছালাম। পদচিহ্নটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম আমি। চূড়ায় প্রচণ্ড ঠান্ডা। মেঘের পর মেঘ এসে ধাক্কা দিচ্ছে। শীতে ঠকঠক করতে করতে প্রায় জমে যাচ্ছিলাম, এমন সময় দেখি ব্যাগ টেনে ওপরে ওঠাতে সাহায্য করায় দুই ভদ্রমহিলা আমাকে খুঁজে বের করেছেন! শুধু তা–ই নয়, তাঁরা আমার জন্য বৌদ্ধ অতিথিশালায় (অতিথি গুহা) একটা জায়গাও ঠিক করে ফেলেছেন। সেখানে গিয়ে দেখি, একটা গুহার মধ্যে হাজার খানেক লোক জড়াজড়ি করে ঘুমাচ্ছে। কোনোমতে একটা বসার জায়গা পেলাম। সময় গড়াতে গড়াতে একসময় শুনি ভীষণ চেঁচামেচি। পাশের জনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে?’ সে মোটামুটি চোখ পাকিয়ে বলল, ‘তুমি বেকুব নাকি? সূর্য উঠছে, দেখো না!’
তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে দেখি, হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছে চূড়ায়। সারি সারি পাহাড় আর মেঘের মাঝ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। সূর্যোদয় তো অনেক দেখেছি, কিন্তু অ্যাডামস পিকের সেই সূর্যোদয় ছিল এক কথায় অপার্থিব। মেঘের ভাঁজে ভাঁজে কেউ যেন ঢেলে দিচ্ছে তরল সোনালি আলো। চারদিকে ঘুরছে মেঘের স্তর আর পাহাড়ের উল্টো দিকে পড়ছে নিখুঁত ত্রিভুজাকৃতি ছায়া—অ্যাডামস পিকের ছায়া।
বগুড়া