আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে : ফাহ্মিদা খাতুন
এই ভূখণ্ডে রবীন্দ্রসংগীতকে গণমানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সংগ্রামে অগ্রণী একটি নাম ফাহ্মিদা খাতুন। তাঁর সুরসাধনার শুরু দেশের জন্য দারুণ এক প্রতিকূল সময়ে। তাঁর গান উজ্জীবিত করেছে বাংলাদেশের মানুষকে। এই গুণী শিল্পী এবার পেলেন মেরিল–প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা।

ফাহমিদা সুর ভাঁজে, এ-ও এক বৃষ্টি অপরূপ,
অস্তিত্ব ডুবিয়ে নামে, গীতবিতানের কিছু নিভৃত নিশ্চুপ
পাতা ওড়ে অলৌকিক কলরবে, গাংচিলের মতো ওড়ে
ঘোরে সারা ঘরে
প্রাণের ঊর্মিল জল ছুঁয়ে যায় কত ছল ভরে।
শামসুর রাহমানের কবিতার কটি পঙ্ক্তি। কেমন গান করেন ফাহমিদা খাতুন, এর অকুণ্ঠ স্বীকৃতি যেন ‘ঋণী’ নামের এই কবিতাটি। তাঁর কাছেই এসেছি আমরা। তাঁর সঙ্গেই কথা বলছি।

২.
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। টেলিভিশনের বাঙালি কর্মকর্তাদের মাথায় তখন এক অভিনব ভাবনা খেলা করছে। রীতি অনুযায়ী রাত ১২টায় পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও জাতীয় পতাকা প্রদর্শনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শেষ করতে হয়। কিন্তু সেদিন ১২টার কাছাকাছি সময়েও বেজে চলেছে উদ্দীপনামূলক গান। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনবরত ফোন আসছে। তাঁরা বুঝি কিছু আঁচ করতে পেরেছেন।
কিন্তু তাঁদের আদেশ-নির্দেশ বিফলে গেল। রাত যখন ১২টা, টেলিভিশনে তখন বাজছে, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গানটি। সেদিন ঘুরে–ফিরে এই গানটি বেজেছে অনেকবার। রাত ১২টা পার হলো গানে গানে। পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসের শেষ মুহূর্তটিতে টেলিভিশনে দেখা গেল না পাকিস্তানের পতাকা, শোনা গেল না জাতীয় সংগীত।
‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গানটি ছিল ফাহমিদা খাতুনের কণ্ঠে।

৩.
এই ভূখণ্ডে রবীন্দ্রসংগীতকে গণমানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সংগ্রামে অগ্রণী একটি নাম ফাহমিদা খাতুন। তাঁর সুরসাধনার শুরু দেশের জন্য দারুণ এক প্রতিকূল সময়ে। ধ্রুপদি গানে দীক্ষা মনির হোসেনের কাছে, কিন্তু একসময় হয়ে গেলেন পুরো রবীন্দ্রময়, যদিও পঞ্চকবির আর চারজনের গানেও সমান দক্ষ তিনি।
এ বছর মে মাসের শুরুর একটি দিনে আমরা যখন ফাহমিদা খাতুনের উত্তরার বাড়িতে পৌঁছে তাঁকে নিয়ে কথা শুরু করি, তখন ঘুরে-ফিরে বারবার এসেছে অগ্রজা সন্জীদা খাতুনের নাম। সন্জীদা খাতুনের পরিশ্রমী সাংস্কৃতিক প্রজ্ঞা সঞ্চারিত হয়েছে ফাহমিদার মধ্যেও। সন্জীদাই সুরের আগুন জ্বেলে দিয়েছেন ফাহমিদার মনে। তারপর শুধু এগিয়ে চলা।

ফাহমিদা খাতুনের দিকে তাকিয়ে তাঁর মধ্যে সন্জীদা খাতুনকে খোঁজার চেষ্টা করি। সন্জীদা আপা যদি স্থির দৃষ্টিতে কারও দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘এই, আমাকে ভয় পাও?’ তাহলে অবধারিতভাবে উত্তরদাতা ঢোঁক গিলে সভয়ে বলবে, ‘কই, না তো!’ কিন্তু ফাহমিদা খাতুনের সঙ্গে অনায়াসে কথা বলা যায়। ফাহমিদার মন নরম। রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেটা’ কিংবা ‘দেবতার গ্রাস’ পড়ে সহ্য করতে পারেন না। কষ্ট হয় ভীষণ। ছোটবেলায় এ কবিতাগুলো পড়ে যখন রওনা হতেন স্কুলের পথে, তখন বুঝতেন গলায় কী যেন দলা পাকিয়ে আছে। ব্যস, এইটুকুই পার্থক্য দুই বোনের। বাকিটুক এক, একই আলোর পথযাত্রী দুজন। সন্জীদা খাতুনই আগলে রেখেছেন ফাহমিদা খাতুনকে। তিনিই গড়েপিটে শিল্পী করে তুলেছেন ১৯৪২ সালে জন্ম নেওয়া ছোট বোনটিকে।

৪.
পরিবারটি ছিল সংস্কৃতিমনা। বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনের অন্যতম নেতা জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর বাবা। তুখোড় দাবা খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। গণিত আর পরিসংখ্যান পড়াতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন ফাহমিদা খাতুনের অগ্রজ। বড় বোন যোবায়দা মীর্জাও স্বনামে খ্যাত। ছোট বোন মাহমুদা খাতুন দুই অগ্রজা সন্জীদা খাতুন ও ফাহমিদা খাতুনের মতো রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী।
স্কুলছাত্রী থাকাকালে রবীন্দ্রনাথের চণ্ডালিকা নৃত্যনাট্যে প্রকৃতির মায়ের কণ্ঠ দিয়ে ফাহমিদা চমকে দিয়েছিলেন দর্শক-শ্রোতাদের।
কামরুন্নেসা, ইডেন কলেজ পার হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হলেন কাজী মোতাহার হোসেন ও সাজেদা খাতুনের এই দশম সন্তান (সাত বোন ও চার ভাই মিলে তাঁরা ১১ ভাইবোন)। ষাটের দশকের প্রথমার্ধে হলেন ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক। ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে ছিলেন যুক্ত, তাই সাইফুদ্দীন আহমেদ মানিক, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেননদের সঙ্গে ছিল আদর্শের বন্ধন। মুকুল ফৌজের সক্রিয় সদস্য ছিলেন ছোটবেলা থেকেই।
ধারাপাত নামে চলচ্চিত্রে গাওয়া ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’ গানটি তাঁর প্রথম রেকর্ড। পাকিস্তান আমলে চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত প্রথম রবীন্দ্রসংগীতও এটি।
ষাটের দশকে অধিকাংশ বাঙালিই পাকিস্তানিদের শোষণের বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল। সব অঙ্গনই ছিল বিক্ষুব্ধ। একষট্টি সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীতে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেই অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রগতিশীল সংস্কৃতিসেবীরা। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে হয়েছিল সে অনুষ্ঠান। ফাহমিদার স্পষ্ট মনে আছে অন্ধকার মঞ্চের কথা। তিনি গাইছেন ‘হৃদয় আমার প্রকাশ হল অনন্ত আকাশে’। আস্তে আস্তে মঞ্চে আলো আসছে। গান চলছে আর আলো এসে পড়ছে মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের ছবির ওপর। সে এক অপরূপ দৃশ্য! আজও সে সুখস্মৃতি রয়ে গেছে তাঁর মনে।

৫.
শেখ লুত্ফর রহমান, আবদুল আহাদ, আবদুল লতিফ, আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে মিলে গেয়েছেন গণসংগীত। বিশেষ করে মনে পড়ে জাহিদুর রহিমের কথা। রবীন্দ্রগীতিনাট্যের প্রায় সব কটিতেই মূল দুই চরিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন তাঁরা দুজন। আর প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানেই ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘বিচারপতি তোমার বিচার,’ ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গাওয়া চলতেই থাকল।
আলতাফ মাহমুদ গান শেখাতেন খুব সুন্দর করে। এমনভাবে গাইতেন যে যিনি শিখছেন, তাঁর মধ্যেও একটা রোমাঞ্চ চলে আসত। একুশে ফেব্রুয়ারির অমর গানটির ‘সেদিনও এমনি নীল গগনের’ অংশটি ফাহমিদাকে দিয়ে গাওয়াতেন আলতাফ মাহমুদ। আইপিটিএর (ভারতীয় গণনাট্য সংঘ) গণসংগীতগুলো উঠে আসত কণ্ঠে। তাতে উজ্জীবিত হতো দেশের মানুষ।


৬.
রবীন্দ্রনাথের গানগুলো অর্থ ধরে বুঝিয়ে দিয়েছেন সন্জীদা খাতুন। তাই আলাদা করে প্রিয় গান খুঁজে বের করা কঠিন। তার পরও অনেক ভেবে বললেন তিনটি গানের কথা, ১. ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে’, ২. ‘আজি যে রজনী যায় ফিরাইব তায় কেমনে’, ৩. ‘খেলা যখন ছিল তোমার সনে’। এ কথা বলার সময় জোর দিলেন একটি বিষয়ে, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রেম, পূজা পর্যায়ের অনেক গান আছে, যেগুলোর মধ্যে ভাবনার দিক থেকে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না।’
‘আপনার কি অতৃপ্তি আছে?’

‘আসলে শেখাটা তো সেভাবে হয়নি। আরও যদি ভালো করে শিখতে পারতাম! ম্যাট্রিকে বিষয় হিসেবে ছিল সংগীত। মনির হোসেনের কাছে শিখেছি পাঁচ বছর। ধ্রুপদিটা যদি আরও ভালো করে শিখতে পারতাম! এখনকার ছেলেমেয়েরা সুযোগ পাচ্ছে, খুব ভালো শিখতে পারছে। ওই সুযোগটা আমি পেলে আফসোস থাকত না।
‘মোহরদি (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) আমাকে গান শেখাতে চাইতেন। কিন্তু আমি সে সুযোগটা নিতে পারিনি। তিনি খুব চাইতেন, তিন মাসের জন্য ছুটি নিয়ে হলেও তাঁর কাছে যেন গান শিখতে যাই। কিন্তু আমি তো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করি। কীভাবে যাব? তিনি তাতে খুব অভিমান করেছিলেন। শিশুর মতো ছিলেন মোহরদি। যদি তাঁর গান করতাম, উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন, নীলিমা সেনের গান করলে ভারী হয়ে উঠত তাঁর মুখ। ইংল্যান্ডে একবার ধরে ধরে আমাকে গান শিখিয়েছেন। টপ্পা ধরনের গানগুলো দেখিয়ে দিয়েছেন। ‘“দিনান্ত বেলায় শেষের ফসল নিলেম তরী পরে” গানটির “ভেসে যায়” উচ্চারণ করাটা শিখিয়ে দিলেন, যেন “ভেসে” শব্দটাকে ভাসিয়ে দেওয়া হলো। গভীরতা কাকে বলে, তা বুঝেছি তখন।’

৭.
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন ২০০৭ সালে। এখন রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, ঢাকার উত্তরা শাখার সভাপতি তিনি। বাড়িতে ও ছাদে বাগান করেছেন। নিয়মিত বাগানের পরিচর্যা করেন। স্বামী লুৎফুর রহমান মারা গেছেন। একমাত্র ছেলে অর্ঘ্য সপরিবারে থাকে কানাডায়। মাঝে মাঝে দেশে আসে। দেখা করে যায় মায়ের সঙ্গে।
দীর্ঘ চলার পথে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। সিকোয়েন্স পুরস্কার, জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সম্মাননা, কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী স্মৃতি সম্মাননা, রবীন্দ্রনাথের জন্মসার্ধশতবর্ষে ভারতের রবিতীর্থের সম্মাননা, বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র পুরস্কার, চ্যানেল আইয়ের রবীন্দ্রমেলায় আজীবন সম্মাননা, শিল্পকলা একাডেমীর সামগ্রিক অবদানের জন্য শিল্পকলা পদক।
এবার পেলেন মেরিল–প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা।
সুরসাধনায় তাঁর শ্রম ও নিষ্ঠা অব্যাহত থাকুক।
