আত্মহত্যা: গণব্যর্থতার নিঃসঙ্গ শাস্তি

অলংকরণ: আরাফাত করিম

আত্মহত্যার আগে কেউ কেউ চিরকুট লিখে যায়। কেউ হয়তো কিছুই বলে না। কিন্তু তাদের সবার জন্যই অপেক্ষা করে লাশকাটা ঘর। হাসপাতালের সেসব লাশকাটা ঘর এখন ফাঁকা থাকে না। কত মানুষ আসে! তবে এখন যেন বেশি আসছে তরুণ-তরুণীর লাশ। গত এক সপ্তাহেই আত্মহত্যা করেছেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী। তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, করোনা মহামারির মধ্যে গত ১৫ মাসে আত্মহত্যা করেছে ১৫১ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে সাড়া ফেলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক মেধাবী ছাত্র মাহাদি হাসান অপু। অপু মেধাবী ছিলেন, প্রতিবাদীও ছিলেন। গত সপ্তাহে রাজধানীর এক মেসঘরে তাঁর ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়।

শেষ চিরকুটে লেখা থাকে ব্যক্তিগত হতাশার কথা। অভিমানের কথা। যে মানুষ বা যে জিনিস না পেলে জীবন বৃথা বলে মনে হয়, সেই মানুষ বা জিনিস না পাওয়ার কথা। তদন্তকারী পুলিশ বা ময়নাতদন্তকারী সার্জনরা এ রকম অনেক কারণের কথা জানেন। কখনো কখনো আত্মহত্যায় প্ররোচনার অপরাধীর নামও জানা যায়। কিন্তু যার নাম কোনো মামলার অভিযোগপত্রে কিংবা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আসে না, তার নাম ডিপ্রেশন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মাহাদি হাসান
ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ এশীয় কোনো ভাষায় ডিপ্রেশন বোঝানোর কোনো শব্দ নেই। নেই বলে কত বড় ঘুণপোকা আমাদের জীবনের ভিত খেয়ে ফেলছে, তা আমরা অনেক সময় বুঝতেও পারি না। আমাদের কয়েক প্রজন্ম আগের মানুষ জানত না কাকে বলে ডিপ্রেশন। আমরা জানি, বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন কী। ডিপ্রেশন আধুনিকতার মানসিক গন্ধম ফল।

আধুনিক এই সময় শেখায়, ভোগই সুখ। জীবনের মানে ততটাই, যতটা তোমার ভোগের মুরদ। এই পণ্যময় জীবন খালি পেতে শেখায়। পরীক্ষায় ভালো নম্বর, চেহারায় সুন্দর জেল্লা, চাকরির মেওয়া ফল, মোহনীয় প্রেমিক-প্রেমিকা, তুমুল খ্যাতি ও সম্পদ না পেলে নাকি জীবন বৃথা। সফল ও কামিয়াব হওয়ার জন্য তখন চলে অমানবিক প্রতিযোগিতা। ছুটতে ছুটতে আমাদের পা হয়ে যায় সিস্টেমের চাকা। কিন্তু মর্মান্তিক পরিহাস এখানেই, ভোগের বীরদেরও ক্লান্তি আসে। আর যারা সফল নয়, চেষ্টা করতে করতে তাদের ক্লান্তি আসে চেষ্টা–পণ্যায়িত জীবনে যে সফল এবং যে ব্যর্থ, দুজনেই একই সমস্যার দুই শিকার। সেই সমস্যার নাম অবসাদ। আত্মহত্যার পেছনে প্রত্যক্ষ কারণ হয়তো নানান রকম ব্যর্থতা বা মানসিক ধাক্কা। কিন্তু পরোক্ষ কারণ এই ডিপ্রেশন, বাংলায় যার কাছাকাছি শব্দ হলো অবসাদ। অবসাদ আত্মাকে শুকিয়ে ফেলে, খেয়ে ফেলে বাঁচার জন্য গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার ইচ্ছাশক্তি। আত্মহত্যা নামের ভালুকের থাবার তলে চলে যায় তখন অনেকেই।

২০১৬ সালের হিসাবে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ডিপ্রেশনে ভোগে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০১৬)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডিপ্রেশনই ১৫-২৯ বছর বয়সীদের আত্মহত্যার জন্য দায়ী। অসন্তোষ, অনিশ্চয়তা, অজানা বিপদ বা ব্যর্থতার ভয় আধুনিক জীবনের ছায়াসঙ্গী। এটা একজনের বা অল্প কয়েকজনের ওপর ছায়া ফেলে না, এর শিকার গোটা সমাজ।

সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে, মানুষ মানুষকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। জীবনের মানে কী, তা খুঁজে হয়রান আজকের তারুণ্য। কোনো একটা মানে আঁকড়ে ধরার পরেই দেখা যায়, চারপাশে চলছে অন্য মানে খোঁজার বিজ্ঞাপন। একজনের সফলতার ফলাও প্রচার নিরানব্বই জনকে ঈর্ষায় আরও হতাশ করে ফেলে। তারা ভাবে, ‘আমার দ্বারা বোধ হয় আর কিছু হলো না!’ বন্ধুত্বের খোলসের ভেতর লুকানো ফেসবুক প্রোফাইলগুলো যেন নিঃসঙ্গ জালে বসে থাকা মাকড়সার মতো করুণ।

তাই দেখা যাচ্ছে, গত এক দশকে সবচেয়ে প্রতিবাদী, সবচেয়ে মেধাবীদের হতাশা গ্রাস করছে। বাস্তবতার সঙ্গে লড়াইয়ের জেদ নষ্ট করে দিচ্ছে নেশার রেশমি ফাঁস। বণিক সভ্যতার এই শূন্য মরুভূমি কীভাবে পার হবে তারা? আমাদের সময়ের তারুণ্য যেন গণনিঃসঙ্গতার শাস্তিপ্রাপ্ত।

প্রতিষ্ঠান, আইন, রাজনীতি থেকে আশ্বাস আসছে না। আস্থা রাখা যাচ্ছে না কর্তৃপক্ষের ওপর। সিস্টেম কেবলই ভয় দেখায়, নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে বড় সামাজিক আন্দোলন নেই যে প্রেরণা জোগাবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তো আত্মহত্যা দেখা যায়নি, বড় গণ-আন্দোলনের সময়ও আত্মঘাতী অবসাদ দেখা যায় না। পুরোনো সমাজে সম্পর্কের বন্ধন ছিল কঠিন, নীতিনৈতিকতা ছিল স্পষ্ট। আস্থা রাখার মতো অভিভাবক, নেতা বা শিক্ষক বা বন্ধু কিংবা প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু ভোগের আর মুনাফার আগুনে সেই কঠিন সম্পর্কগুলো গলে যাচ্ছে। আজকের তরুণদের অনেকেই সামনের দিকে চেয়ে নিশ্চয়তা পায় না। এই তরল সময়ে গতি আছে, প্রলোভন আছে, সীমা ডিঙানোর তাড়না আছে, কিন্তু সুখ নেই, ভরসা নেই, ভবিষ্যতের নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি নেই। আমাদের সমস্যাগুলো যতই সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় হোক, তা উতরানোর দায় যেন ব্যক্তির একার। সেই ব্যক্তি তো অসহায়, নিরুপায়, নিঃসঙ্গ।

আত্মহত্যা যে করে, নিরুপায় হয়ে করে। কিন্তু যার কাছে বেঁচে থাকা অসহনীয়, তাকেও বলি, বন্ধু তুমি তো ভবিষ্যৎ জানো না। তাহলে কেন আগামীকালের ভয়ে আজকের প্রাণটা বিসর্জন দিচ্ছ? কেন জিতিয়ে দিচ্ছ সিস্টেমের প্রাণখেকোদের? হারানো সময়, সমাজ ফিরে আসবে না। তারপরও নতুন করে বন্ধুত্ব, আপন মানুষের ছোট সমাজ এবং তরুণদের ধারণকারী প্রতিষ্ঠান গড়া যায়। মানবিক সমাজে কেউ একা একা হারিয়ে যাওয়ার আগে দশবার চিন্তা করে। সিস্টেমের কারণে তৈরি হওয়া ব্যর্থতার জন্য নিজেকে যেন দায়ী না করি আমরা। বরং আসল দায়ী যে নিষ্ঠুর ও অমানবিক ব্যবস্থা, তাকে কাঠগড়ায় তুলতে হলে নিজেদের হৃদয়, চিন্তা, সম্পর্ক আর সম্ভাবনাকে যেন ফলিয়ে তুলতে পারি আমরা। সত্যিই তো, আজ দিন খারাপ বলে কালকের দিনটা ভালো হবে না, তা কি কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে?