আবার কবে আসবি বাবা?
ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছিল ছেলের পরিবার। ছেলে, বউমা, নাতি—যার যেটা পছন্দ সব ব্যবস্থাই মা–বাবা করেছিলেন আনন্দে। ছুটি শেষে চলে গেল ওরা। আবারও প্রতীক্ষা মা–বাবার

এক.
গোটা রমজান মাস প্রস্তুতি চলেছে আমেনা বেগমের। গ্রীষ্মের শুরুতে কাঁচা আমের আচার করে রেখেছিলেন, ওগুলো রোদে শুকালেন। চিতই পিঠা করবেন বলে চালের গুঁড়ো করে রেখেছেন। গাছিবাড়ি পাঠিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে গুড় করিয়ে এনেছেন। নিজের গাছের সুগন্ধি লেবুগুলো রোজ পাহারা দিচ্ছেন ওরা এলে ছিঁড়বেন বলে। খাঁটি ঘিয়ের ফরমাশ দিয়ে রেখেছেন গোয়ালাকে, সঙ্গে যেন রোজ দুই সের করে দুধ দিয়ে যায় ওরা এলে। শবে কদরের রাতে নামাজ পড়ে ভোরবেলা এসে দাঁড়িয়ে রইলেন বারান্দায়—আর তো একটা দিন। সময় যেন যায় না। আহা, কাল টিভি সংবাদে দেখেছেন বাড়ি ফেরা মানুষের ভোগান্তি। ওরা যেন সহি-সালামতে আসে। থাকবে তো মোটে পাঁচ দিন। আর এই পাঁচ দিনের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন মা আমেনা বেগম। দিন গোনেন। কবে আসবে ঈদ! ঈদেই সব কাজ ফেলে ছেলে, বউ, নাতি-নাতনি বাড়ি ফেরে। মায়ের কাছে ফেরে!
দুই.
সেহ্রির সময় টিকিটের জন্য রেলস্টেশনে লাইনে দাঁড়ানো। ধাক্কাধাক্কি করে টিকিট হাতে পাওয়া। বাড়িঘর গুছিয়ে তীব্র যানজটের মধ্যে মালপত্র নিয়ে কোনো রকমে স্টেশনে পৌঁছে প্রায় যুদ্ধ করে বগিতে ওঠা। যথারীতি ট্রেন লেট। পথে পথে দেরি। সাত ঘণ্টার যাত্রা গিয়ে ঠেকে ১২ ঘণ্টায়। শিশুটি কাহিল হয়ে পড়ে এই যাত্রাক্লান্তিন্তে। অসুস্থ বোধ করেন নিজেরাও। কিন্তু ট্রেন যতই নিজের শহরের কাছাকাছি পৌঁছায়, ততই চনমনে হয়ে ওঠেন সদরুল আমিন। ওহ্, পথ যে কেন শেষ হয় না। নিশ্চয় টিনের ছাদে বৃষ্টির কানেস্তারা বাজছে এখন, বাবা হাঁকডাক করে ছাতা নিয়ে বাজারে গেছেন, পাড়ার সবাই দেখা হলেই চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, সদরুল আসছে নাকি ভাইসাব? কত দিন পোলাটারে দেখি না, উঠানময় তুরতুর করে হেঁটে বেড়াচ্ছে মুরগির বাচ্চাগুলো, বিন্তির মা ওদের ঘর ঝাড়পোঁছ করে নতুন ধোয়া চাদর বিছাচ্ছে এখন। আর মা? মায়ের মুখটা মনে পড়তে তাড়াতাড়ি সদরুল স্ত্রী-পুত্রকে গোপন করে দৃষ্টিটা দিগন্তে মেলে ধরেন। শত কাজের মাঝেও মা নিশ্চয় এখন বারবার চঞ্চল দৃষ্টিতে পথের দিকে তাকাচ্ছেন, ঘর-বার করছেন বারবার, মায়ের নিশ্চয় তর সইছে না। বছরে এই দুটো ঈদ—এই দুটো দিন মা-বাবার বোধ হয় সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত দিন। এই কদিনে উজাড় করে দিতে চান সারা বছরের জমিয়ে রাখা সব ভালোবাসা।
ঈদে বাড়ি ফেরা—সংবাদ শিরোনাম থেকে শুরু করে যোগাযোগমন্ত্রীর মাথাব্যথা, টক শো—এই ঝড় নানা পর্যায়ে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে এই সময়। কিন্তু আসলে এই বাড়ি ফেরা মানে দীর্ঘদিনের অপেক্ষা। যে অপেক্ষায় হয়তো শামিল বাবা-মা থেকে শুরু করে পাড়ার চাচি, ছেলেবেলার বন্ধু, দোকানের কাকা এমনকি ঘরের পাশের লেবুগাছটাও। আর এই ক্ষণস্থায়ী আনন্দ ফুরিয়ে যেতে সময় লাগে না একটুও। দু-চার, পাঁচ দিন কেটে যায় মহানন্দে-মহা সমারোহে এক লহমায়। তারপর সেই বিদায় জানানো, সেই ছলছল চোখ, সেই আবার কবে আসবি বাবা।
উৎসব বা বিশেষ দিন ছাড়া, উদ্যাপন ছাড়া, সারা বছর আমরা বাড়ির কথা, বাবা-মায়ের কথা আসলে কতটুকুই ভাবি বা উপলব্ধি করি। শহুরে ব্যস্তজীবনে ছোটাছুটির মধ্যে কতই-বা মনে করি তাঁদের। কেমন কাটে তাঁদের একলা দিন, একলা রাতগুলো, তার কতটা খবর রাখি?
ঢাকায় থাকেন ব্যাংক কর্মকর্তা শহিদুর রহমান। বললেন, ‘প্রতিবারই ঈদ শেষে চলে আসার সময় অপূর্ণতাটা থেকে যায়। হুল্লোড়ে ভালো করে সময়টাই যেন কাটানো হলো না বাড়িতে। ভেবেছিলাম ছেলেকে নিয়ে বড়শি দিয়ে মাছ ধরব, মাস্টার কাকার বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল, কথা ছিল এক দিন সন্তানদের নিজের পাঠশালাটা দেখাব—তাড়াহুড়ো আর দাওয়াত খেতে গিয়ে সময় হয় না কোনোবারই। তাই ভাবি, শুধু ঈদ নয়, হঠাৎ দুই দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলে কী আনন্দটাই না হবে! আগে বছর শেষে স্কুল ছুটি হলে আমরা মামার বাড়ি-দাদুর বাড়ি বেড়াতে যেতাম,। ইদানীং ছুটি মানে ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়া। সেটা যে খারাপ তা বলছি না, কিন্তু দেশের ভেতর বা বাইরে বেড়াতে যাওয়ার সময় বাবা-মাকেও সঙ্গী করে নিলে কেমন হতো? তাঁদেরও সময় দেওয়া হতো, ঘোরাঘুরির মজাটাও একটা আলাদা মাত্রা পেত। এ রকম নানা ভাবেই, নানা ফাঁকেই তো আমরা পরিবারের জন্য সময় বের করে নিতে পারি।’
ঈদে বা উৎসবে বা ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার একেবারে পারিবারিক বা ব্যক্তিগত আবহের বাইরেও বড় একটা সামাজিক আবেদন আছে—এমনটাই মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ফারজানা রহমান। তিনি বলেন, ‘এই বাড়ি যাওয়া কেবল বাবা-মায়ের কাছে ফেরা নয়, নিজের শিকড়, অস্তিত্ব, প্রকৃতির কাছে ফেরা, আত্মীয়স্বজনের বাইরেও সেই গোয়ালা, সেই ময়রার দোকানদার, ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া বন্ধু, প্রতিবেশী খালাম্মা, নৌকার মাঝি—সবাই মিলেমিশেই এই ফেরার আনন্দের অংশীদার। এই ফাঁকেই কিন্তু অনেক কিছুর বিনিময় হয় এতে। আমরা বা আমাদের সন্তানেরা পায় প্রকৃতির অফুরান উপহার, অকৃত্রিমতার স্বাদ, গাছে উঠে পাখির বাসা দেখার বা পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরার ‘নন-ভার্চুয়াল’ আনন্দ, যা সারা বছর প্রেরণা জোগাবে, উজ্জীবিত করবে।’ ওদিকে এলাকার লোকও আপনার কাছ থেকে জানতে পারে অনেক কিছু, বছরে ওই কয়েক দিনেই কিন্তু আপনি আপনার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কিছুটা ভাগ দিতে পারেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে আচরণ, শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, নানা কুসংস্কার ও অজ্ঞতার বিষয়ে আপনার মতামত শেয়ার করতে পারেন এ সময়। এটাই হতে পারে সবচেয়ে বড় ঈদ উপহার। আর হ্যাঁ, শহুরে ব্যস্ততায় আর দৌড়ে যা ভুলে গিয়েছিলেন, সেই ভুলে যাওয়া স্বপ্ন বা ইচ্ছে—তাও মনে করিয়ে দেয় এই বাড়ি ফেরা। ভালো কিছু করার তাগিদ বা প্রেরণাও পেতে পারেন এ থেকে। পরেরবার গ্রামের শিশুদের জন্য গল্পের বই নিয়ে আসব বা এবার ঢাকায় ফিরে চিকিৎসক বন্ধুদের কাছ থেকে ওষুধ জোগাড় শুরু করে দেব—এ ধরনের প্রত্যয় জন্ম নিতে পারে এই বেড়ানো থেকে। তাই ঈদে বা উৎসবে বাড়ি ফেরার এই আনন্দকে পাথেয় করে সারা বছর কীভাবে বাবা, মা এবং শিকড়ের আরও কাছাকাছি যাওয়া যায়, তারই একটা ছক করে নিলে ক্ষতি কী?