আবাসিকে বাণিজ্যের দাপট!

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ইমারত নির্মাণ আইনের তোয়াক্কা না করে নগরের অভিজাত আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি বিদ্যালয়। এ নিয়ে নানা বিড়ম্বনার িশকার হচ্ছেন আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা।
১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ আইনের ৩–এর ক ধারায় উল্লেখ আছে, আবাসিক বাড়ির জন্য ইমারত নির্মাণের অনুমতি নিলে ওই ভবনকে আবাসিক কাজেই ব্যবহার করতে হবে। অন্য কোনো কাজে, যেমন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ বেশির ভাগ বাড়ির মালিক তা মানছেন না।
বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি আলী আশরাফ প্রথম আলোকে বলেন, আবাসিক এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বাণিজ্যিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় সেখানে অসহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে আসা গাড়ির কারণে সেখানে প্রায় সময় যানজট লেগে থাকে। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
সম্প্রতি সিডিএ নগরের চারটি আবাসিক এলাকায় অনুমোদন ছাড়া গড়ে ওঠা ৯৩টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করেছে। সিডিএর তালিকা অনুযায়ী, নগরের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪৮টি, কাতালগঞ্জে ১৮টি, নাসিরাবাদে ১৮টি ও খুলশী এলাকায় রয়েছে ৯টি। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যালয় ও কলেজ, কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র, মাদকাসক্ত নিরাময়কেন্দ্র, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি কার্যালয়, সুপার শপ, বিউটি পারলার, রোগ নির্ণয়কেন্দ্র, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কার্যালয় ইত্যাদি।
সিডিএর চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম প্রথম আলোকে বলেন, আবাসিক এলাকায় অনুমোদন ছাড়া গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কার্যালয় সরিয়ে নিতে একাধিকবার বলা হয়েছে। কিন্তু তারা সরিয়ে নেয়নি। এবার প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্ছেদে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সম্প্রতি নগরের নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ৪ নম্বর সড়কের ২১ নম্বর প্লটের চারতলা ভবনে চলছে সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সামনে সারি সারি গাড়ি দাঁড়ানো। একই সড়কের ৪/বি ২ প্লটের ভবনে রয়েছে অর্কিডস স্কুল। বিদ্যালয়ের সঙ্গে লাগোয়া অংশে টেইলার্সের দোকানও রয়েছে। ৬ নম্বর সড়কেও আছে পিনাকল চার্টার্ড কলেজ নামের আরেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এই আবাসিক এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার চৌধুরী বলেন, বিদ্যালয়গুলোর ক্লাস শুরুর আগে ও ছুটির পর এলাকায় গাড়ির জট লেগে যায়। তখন বাসা থেকে বের হলে ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ এ জে এম শহীদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবাসিক এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলে বাসিন্দাদেরও লাভ। তাঁদের ছেলেমেয়ে সেখানে পড়তে পারে। আর চট্টগ্রাম শহরে তো টাকা দিলেও জায়গা পাওয়া যায় না। এ জন্য আমাদের এখানে থাকতে হচ্ছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে কিছুটা যানজট হয়।’

নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আবাসিক এলাকার ১ নম্বর প্রবেশমুখের ভবনের নিচতলায় গড়ে উঠেছে আলফা ল্যাব নামের একটি রোগ নির্ণয়কেন্দ্র। প্রায় আড়াই বছর ধরে এই কেন্দ্রের কার্যক্রম চলছে বলে জানান অভ্যর্থনাকারী। তবে ওই সময় কেন্দ্রে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রটির সামনে চারটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
একই আবাসিক এলাকার ৬ নম্বর সড়কে দেখা যায় একটি ভবনের নিচতলায় মুদির দোকান ও অন্য একটি ভবনে বিউটি পারলার। ৩ নম্বর সড়কে রয়েছে বেসরকারি সংস্থা প্রশিকার কার্যালয়। এই সড়কের নালার পাশে অন্তত পাঁচটি দোকান গড়ে উঠেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে চা ও মুদির দোকান। এই আবাসিক এলাকার ২ নম্বর গেটের প্রবেশমুখের ভবনগুলোর নিচতলা রয়েছে বিউটি পারলার ও মনোহাির দোকান। এলাকার প্রধান সড়কের ওয়াই ৯/৭ নম্বর প্লটে চলছে সিটি মডেল স্কুল ও কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম।
চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় অবস্থিত সিটি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ বাবুল কান্তি ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগরের অন্যান্য আবাসিক এলাকায়ও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এভাবে এখানেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছে। আর সরকার চলে যেতে বললে তখন অবশ্যই চলে যাব।’
আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভবন ভাড়া দেওয়া ঠিক হয়নি বলে স্বীকার করেছেন চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার পাঁচ ভবন মালিক আমিনুল হক, বশির উদ্দিন, আবুল কালাম, সৈয়দ আবুল হোসাইন ও আমিন নূর। সিডিএর নির্দেশ পেলে ভবন থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো সরিয়ে নেওয়া হবে বলে জানান তাঁরা।
চান্দগাঁও সিডিএ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির সভাপতি হাসান মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকার কারণে খুবই সমস্যা হচ্ছে। অনেক দোকানে বহিরাগত ও মাদকাসক্তদের আড্ডা বসে। অনেক সময় সেখান থেকে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা হয়। আবার দোকানগুলোর সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখার কারণে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। আবাসিক এলাকা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সিডিএ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন হাসান মাহমুদ চৌধুরী।
চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকার ১ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর প্লটে রয়েছে স্কাস টেকনিক্যাল সেন্টার নামে একটি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র। একই ভবনে লুবনান নামে একটি বিউটি পারলারও রয়েছে। ২ নম্বর সড়কে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কয়েকটি মনোহাির দোকান রয়েছে। এই এলাকার ৪ নম্বর সড়কে আছে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। এসব প্রতিষ্ঠানের সামনের সড়কের ওপর ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
সিডিএ সূত্র জানায়, গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করে ৩০টি নির্দেশনা দেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নির্দেশনা ছিল, আবাসিক এলাকায় যত্রতত্র হাসপাতাল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা যাবে না। এ ছাড়া এসব এলাকায় ব্যাপক জনসমাগম হয় এমন স্থাপনাও নির্মাণ করা যাবে না। পাশাপাশি অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্রমান্বয়ে স্থানান্তরের উদ্যোগ নিতে হবে।
জানতে চাইলে সিডিএর অথরাইজড কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইলিয়াছ তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আবাসিক এলাকাগুলোতে বাণিজ্যিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে সিডিএর কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি এসব প্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হয়েছে।
আবাসিক এলাকায় এসব প্রতিষ্ঠান কীভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে জানতে চাইলে মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, ‘সিডিএতে জনবল সংকট রয়েছে। আবার যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট নেই। ফলে আবাসিক ভবনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও তা ঠিকভাবে তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিডিএতে দুই অথরাইজড কর্মকর্তার অধীনে পরিদর্শক রয়েছেন ১৪ জন। তাঁরাই মূলত নগরের ভবনগুলো তদারকি করেন।
সিডিএর নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আবু ঈসা আনছারী প্রথম আলোকে বলেন, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা রেখে আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু সেখানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে স্থানীয় বাসিন্দারা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। আর বাণিজ্যিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে সেখানে পরিকল্পনার চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ ও গাড়ির সমাগম ঘটে। এ ছাড়া বহিরাগতদের আনাগোনার কারণে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।