আমরাও কুস্তি লড়ি

ভয়কে জয় করে কুস্তি লড়ছেন তাঁরা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
ভয়কে জয় করে কুস্তি লড়ছেন তাঁরা। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

‘যখন আমাকে জানানো হলো কাবাডি খেলা বাদ দিয়ে কুস্তি লড়তে হবে, তখন মন একেবারে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ভয় লাগে। নিজেকে রক্ষা করার কৌশলটি আয়ত্ত করতে পারিনি বলে প্রতিপক্ষ মাথা দিয়ে নাকে গুঁতা মারে। প্রচণ্ড ব্যথা পাই। তবে এখন আমার সামনে কেউ আসতে ভয় পায়।’ কথাগুলো বলেন রাজশাহীর মরিয়ম খাতুন। তিনি বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কর্মরত। গত বছর থেকে কুস্তি খেলছেন।

নারীদের কুস্তির জন্য এখন পর্যন্ত নারী প্রশিক্ষক নেই। ময়মনসিংহের শিরিন সুলতানার কণ্ঠে দৃঢ়প্রত্যয়, ‘কোচ হিসেবে প্রশিক্ষণের লেভেল ২ কমপ্লিট করেছি। ভবিষ্যতে আমাকে কোচ হিসেবে দেখতে পাবেন আশা করি।’

মরিয়ম, শিরিনদের মতো দেশের নারী কুস্তিগিরেরা বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো সাউথ এশিয়ান গেমস খেলতে যাচ্ছেন। আগামী বছরের ৬ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি এ খেলা হবে ভারতের গুয়াহাটি ও শিলংয়ে। খেলতে যাওয়ার আগে এই খেলোয়াড়দের কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। চূড়ান্ত বাছাইপর্বে বিজয়ী হলেই তাঁরা সাউথ এশিয়ান গেমস খেলার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।

সম্প্রতি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পরিচালিত রাজধানীর সুলতানা কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্সের হোস্টেলে কথা হয় নারী কুস্তিগিরদের সঙ্গে। হোস্টেলে জাতীয় দলের মোট ১৩ জন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ডিসেম্বর মাসেই চূড়ান্ত বাছাই। তাই এখন তাঁদের দম ফেলারও ফুরসত নেই। প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে গত আগস্ট মাস থেকে নারী কুস্তিগিরেরা এ হোস্টেলে থাকছেন। দিনে হাত খরচ ২৭৫ টাকাসহ খাবার ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। নারী কুস্তিগিরেরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসার বাহিনীতে কর্মরত।

কুস্তিগির মানেই চোখের সামনে মোটাসোটা, বিশেষ করে দুই পুরুষ ভয়ংকর কুস্তি লড়ছেন, সে দৃশ্য মনে ভাসে। টেলিভিশনে তো সে রকমই দেখায়। নারী কুস্তিগির তো তেমনই হওয়ার কথা। তবে দুপুরবেলা হোস্টেলে ঢুকে ১৩ জনের মধ্যে ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে সে ধারণা বদলে গেল। এই নারীদের ওজন ও উচ্চতা স্বাভাবিক।

 কুস্তিগিরেরাই জানালেন, এই খেলার নাম হচ্ছে ফ্রি স্টাইল রেসলিং। বাংলায় কুস্তি বলা হচ্ছে। এখানে ওয়েট বা ওজনভিত্তিক খেলা হয়। কৌশলে প্রতিপক্ষকে শুইয়ে ফেলতে হয়। পয়েন্টের মাধ্যমে নকআউট করতে হয়। খেলার সময় পক্ষ-প্রতিপক্ষ কমবেশি আহতও হন। তবে ভয়ের কিছু নেই।

সব খেলা রেখে কুস্তি কেন? এ প্রশ্নে কুস্তিগিরেরাও খানিকটা হেসে নিলেন। জানালেন, বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতজনেরাও একই প্রশ্ন করে। হাসাহাসিও করে অনেকে। মেয়ে কুস্তি লড়ে, কারও কারও পরিবার তা খুব সহজেই মেনে নিয়েছে। তবে অনেকে নিজের পরিবার বা শ্বশুরবাড়িতে এখন পর্যন্ত জানাননি। একজন বললেন, ‘বিয়ের পর স্বামী জেনেছেন আমি কুস্তি লড়ি। ঢাকায় এসে আমার খেলা দেখার পর আশ্বস্ত হয়েছেন। কিন্তু ছেলের বউ পুলিশ, খেলোয়াড়—এটুকু মেনে নিয়েছে শ্বশুরবাড়ি। ছেলের বউ ‘কুস্তিগির’, তা মেনে নেবে বলে মনে হয় না। তাই আমরাও আর আগ বাড়িয়ে বলিনি।’

ময়মনসিংহের শিরিন সুলতানা অবশ্য বললেন, ‘বিয়ের পাত্র হিসেবে এমন একজনকে খুঁজছি, যিনি বউ কুস্তিগির তা জেনেই বিয়ে করতে আসবেন।’ শিরিন কুস্তিতে বেশ কয়েকবার জাতীয় পর্যায়ে এবং ২০১২ সালে ভারতে দ্বিতীয় ইন্দো বাংলা রেসলিং চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক পেয়েছেন। কুস্তির আগে কাবাডি ও চায়নিজ মার্শাল আর্ট উশু খেলতেন তিনি। তাঁর বাবা নেই, মা আছেন। দুই ভাই ব্যবসায়ী। শিরিন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করছেন।

খুলনার মেয়ে রিনা আক্তার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে গত বছর সৈনিক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই তাঁর খেলার নেশা। আরেক বোন জাহানারা আক্তার জুডো খেলেন।

নড়াইলের মিনা খাতুন সেনাবাহিনীর নারী সৈনিক ব্যাচের একজন সৈনিক। তাঁর বাবা একজন কৃষক। মিনা মায়ের উৎসাহেই কুস্তি খেলছেন।

রাঙামাটির নদী চাকমা আনসার বাহিনীর একজন ভাতাপ্রাপ্ত খেলোয়াড় (নিয়মিত চাকুরে নন)। মাসে পাচ্ছেন পাঁচ হাজার টাকা। আনসার বাহিনীর হয়ে ভালো করতে পারলে ভবিষ্যতে চাকরি মিলতে পারে। কুস্তির আগে খেলতেন ফুটবল।

 কক্সবাজারের মেয়ে নাসিমা আক্তার পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক। রাজশাহীর রুনা খাতুন, দিনাজপুরের সোমা চৌধুরীসহ কুস্তিগির ১৩ জনের সামনে এখন একটাই লক্ষ্য—বাছাইতে টিকতে হবে। বিদেশের মাটিতে গিয়ে ভালো খেলতে হবে।  দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনতে হবে।

বাংলাদেশ অ্যামেচার রেসলিং ফেডারেশনের জয়েন্ট সেক্রেটারি মেসবাহ উদ্দীন আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে নারীরা কুস্তি লড়ছেন। ৬৪ জেলার প্রতিটিতে ১৬ থেকে ২০ জন করে নারী কুস্তিগির আছেন। এর আগে নারী কুস্তিগিরেরা দিল্লি, কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরে খেলতে গেছেন। ভালো করেছেন। এবারই প্রথম সাউথ এশিয়ান গেমসে যাচ্ছেন। আমরা আশাবাদী, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আমাদের মেয়েরা অবশ্যই ভালো করবে।’

মেসবাহ উদ্দীন জানালেন, এই নারীদের সারা বছর বাড়তি খাবারের ব্যবস্থা করা গেলে তাঁদের কাছ থেকে আরও ভালো ফল পাওয়া সম্ভব। তবে এই খেলোয়াড়দের অনেকের পক্ষেই নিয়মিত বাড়তি খাবার খাওয়া ও অন্যান্য রুটিন মেনে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। ক্রিকেট বা ফুটবলের মতো কুস্তি এখন পর্যন্ত সেভাবে জনপ্রিয়তাও পায়নি। অনেকের পরিবার এখন পর্যন্ত সেভাবে খেলাটিকে গ্রহণ করতে পারছে না। খেলাটি যে অন্য খেলার মতোই, এ নিয়ে ইতিবাচক প্রচার জরুরি।