আমাদের সাইদা খানম

১৮ আগস্ট প্রয়াত হয়েছেন বাংলাদেশের পথিকৃৎ নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানম। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন।

সাইদা খানম (২৯ ডিসেম্বর ১৯৩৭–১৮ আগস্ট ২০২০)। গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় নিজের বাসায়।ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

কাছের মানুষের সম্বোধন হয় সম্পর্কের সূত্রে। আমরা তাঁকে শুধু আপা বলতাম। বাংলাদেশে আলোকচিত্রশিল্পী অনেকেই আছেন, কিন্তু সাইদা আপা তো একজনই ছিলেন। ৮২ বছর বয়সে চলে গেলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানম।

মাত্র ১৩-১৪ বছর বয়সেই ছবি তুলতে শুরু করেছিলেন সাইদা আপা। আজীবন ছবি তুলেছেন ফিল্মের ক্যামেরা দিয়ে। তাই তিনি খুঁজতেন কখন রোদ আসবে, কখন চলে যাবে সেই রোদ। অপেক্ষা করতেন ম্রিয়মাণ আলোর জন্য। সাইদা খানম সেই আলোকচিত্রী, যিনি হুইলচেয়ার নিয়ে বের হলেও তাঁর হাতে থাকত ক্যামেরা।

৬৮ বছর আগে সাইদা আপা যখন হাতে ক্যামেরা তুলে নেন, তখন নিজেও হয়তো ভাবেননি এতটা পথ রয়েছে সামনে। ১৯৫৬ সালে কাজ শুরু করেছিলেন বেগম পত্রিকায়। ১৯৬২ সালে বেগম–এর পক্ষ থেকে সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার নিতে কলকাতায় গেলেন। যে মানিকবাবুকে (সত্যজিৎ রায়) ভয় করতেন অনেকেই, সেই মানিকবাবুই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানমের ক্যামেরার সামনে স্ত্রীসহ বসলেন ছবি তুলতে। এরপর সত্যজিতের তিনটি ছবিতে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করলেন সাইদা আপা।

ব্যক্তিজীবনে এমন সাফল্য তাঁর অনেক। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সেই পঞ্চাশের দশকেই জার্মানি থেকে পেয়েছিলেন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড কোলন পুরস্কার। সে সময়ের এমন কোনো পত্রিকা নেই, যেখানে তাঁর ছবি ছাপা হয়নি। শুধু ছবি নয়, এর সঙ্গে থাকত তাঁর নিজের লেখাও। সাহিত্যিক হিসেবেও তাঁর কাজ গুরুত্বপূর্ণ। সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে তাঁর বই আমার চোখে সত্যজিৎ রায় খুব স্বাদু গদ্যে লেখা। আর তাঁর আত্মস্মৃতিমূলক বই স্মৃতির পথ বেয়ে বাংলা সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাসে এক বিশেষ প্রাপ্তিই বটে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগের একটি সাদাকালো ছবি আমাদের খুব চেনা—অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন নারীরা। ছবিটি সাইদা আপা তুলেছিলেন আজিমপুর এলাকা থেকে। ১৬ ডিসেম্বর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নারী আলোকচিত্রী হিসেবে তাঁর উপস্থিতি বিস্মিত করেছিল অনেককে।

সাইদা খানমের তোলা একটি ঐতিহাসিক ছবি

ব্যক্তিজীবনে সাইদা খানমের সঙ্গে আমার বেশ কিছু স্মৃতি আছে। ২০১৭ সালে নবম ছবিমেলায় আপার সঙ্গে একত্রে সম্মানিত হলাম আমি। সে-ও আমার বিশেষ প্রাপ্তি। তবে ১৯৭৫ সালের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা অসুস্থ হয়ে তখন হাসপাতালে। তাঁর ছবি তুলতে হলে অনুমতির প্রয়োজন। আমি গিয়ে ধরলাম আপাকে। জানতাম, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা সাইদা আপার খালা। তাই তিনি বলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা আমার ক্যামেরায় শুধু ছবি তুলতেই রাজি হলেন তা নয়, একই সঙ্গে একটা কাগজে আমাকে লিখে দিলেন একটি কবিতা।

পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছিলেন সাইদা খানম। এ সূত্রেই অর্জন করেছিলেন প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে নিজের ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করার সাহস। তাঁর পরিবারের মানুষদের সঙ্গে সখ্য ছিল কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সাইদা আপার বড় ভাই ছিলেন বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ও সুরকার আবদুল আহাদ, যিনি রবি ঠাকুর বেঁচে থাকতেই পড়তে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। আর তাঁদের নানা ছিলেন খানবাহাদুর সোলাইমান। তিনি ছিলেন রাজশাহী বিভাগের ডেপুটি কালেক্টর।

আমার ভাবতে ভালো লাগে যে সাইদা আপা ও আমার পৈতৃক বাড়ি একই জায়গায়, বৃহত্তর ফরিদপুরে। ১৯৩৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাবনায় জন্ম নেওয়া সাইদা আপা ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছিলেন। তবে বিচিত্র শখে ছুটে বেড়ানো মানুষ তো আর একমুখী হয় না, তিনিও তেমন ছিলেন। ১৯৭২ সালে তাঁর শখ হলো গ্রন্থাগারবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার। ফলে আবারও স্নাতকোত্তর করলেন। এখানে বলা প্রয়োজন, দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। কিন্তু সবকিছুর পর ছবিই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান।

বার্ধক্যজনিত নানান রোগে ভুগছিলেন দীর্ঘদিন। তবু ক্যামেরা হাতে নিলেই যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠত তাঁর চোখ। আমার সঙ্গে যখন তাঁর শেষ কথা হয়েছিল, সেই কথার মধ্যেও বারবার ঘুরেফিরে এসেছিল ছবি ও ছবি তোলার প্রসঙ্গ।

বাংলাদেশের ইতিহাসের অনেক কিছুর সাক্ষী সাইদা আপার ক্যামেরা। তাঁর ক্যামেরায় ধরা পড়েছে রুগ্ণ শিশুকে স্নেহরত মাদার তেরেসা, অভিবাদন গ্রহণরত বঙ্গবন্ধু থেকে বিজয়ের বাংলাদেশে আনন্দিত মানুষের ছবি। দেখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের নিহত হওয়ার নির্মম দৃশ্যাবলি। ছবির মধ্য দিয়ে যে গল্প বলা যায়, আর সে ক্ষেত্রে নারীরাও যে কোনো অংশে কম নন, সে সাহস বাংলাদেশে প্রথম তৈরি করছেন একজন—তিনি সাইদা খানম।

এই পথিকৃৎ আলোকচিত্রীর জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে একটি অধ্যায়েরও যেন সমাপ্তি ঘটল। তবে প্রয়াণেই তো মানুষের কীর্তি মুছে যায় না। সাইদা খানমের ক্যামেরার চোখে দেখা গল্পগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে।