আমার করোনাকাল

আমার মেয়ে ফারিয়া হোসেন এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেয় ঢাকার মতিঝিল সেন্ট্রাল গভ. গার্লস হাইস্কুল থেকে। নাতনির পরীক্ষা, তাই তার দাদি (আমার মা) শখ করেন, পরীক্ষার পুরোটা সময় ঢাকায় নাতনিকে সময় দেবেন। তাই রেওয়াজ অনুযায়ী মা এটা-ওটা আর মুখরোচক রসমঞ্জরী নিয়ে ঢাকায় এলেন গত জানুয়ারির শেষ দিকে। মেয়েটার পরীক্ষা ভালোই হলো।

পরীক্ষা শেষে মেয়ে বায়না ধরল, ‘আব্বু, দাদির সঙ্গে আমিও গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাব।’ আমাদের বাড়ি গাইবান্ধা। আমাদের বাড়ির ৭-৮ কিলোমিটার পরেই বালাসীঘাট ও কামারজানি বন্দর। ওখানে চিলমারী, রৌমারী, দেওয়ানগঞ্জ ও বিভিন্ন জায়গা থেকে যাওয়া-আসা করে ইঞ্জিনচালিত ও পালতোলা অনেক বড় বড় নৌকা। মনে হয় যেন সাগরের পাড়। মেয়ের খুব ইচ্ছা দেখার। তা-ই হলো। গত ১০ মার্চ মেয়ে গেল তার দাদির সঙ্গে।

কিন্তু ঢাকায় ফেরা নিয়ে হলো সমস্যা। আজ আসবে, কাল আসবে বলে আর আসা হয় না। করোনাভাইরাসের কারণে তখন গণপরিবহন বন্ধ, সারা দেশে সাধারণ ছুটি। গাইবান্ধায় আটকা পড়ে মেয়ের ঢাকায় ফেরা হলো না। মেয়ে ফোনে বলে, ‘আব্বু, আমাকে নিয়ে যাও।’ আমি বলি, আম্মু, পরিস্থিতি ভালো হলে তোমাকে নিয়ে আসব। মা–মেয়ে দুই পাশ থেকে ফোনে কান্না শুরু করে। কথা বলতে পারে না। এদিকে লকডাউন শেষ হয় না।

পলাশবাড়ী মানে গাইবান্ধা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে, সম্ভব নয়। মেয়েকে একা একা এত রাতে পাঠানো ঠিক হবে না। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, বড় ঝামেলায় পড়ে যাব।

আমার এক ভাগনে নীলফামারির সৈয়দপুর বিমানবন্দরে বেসরকারি এয়ারলাইন্সে কাজ করে। তাকে বললাম, বাবা, বিমান চালু হলে তোমার বোনের জন্য একটা টিকিটের ব্যবস্থা করবে। বিমানও আর চালু হয় না। ভাগনে একদিন বলে, ‘মামা, আমাদের এমডি বলেছেন, এখানকার গাড়িগুলো ঢাকায় নিয়ে পুলে রাখবে। আপনি পারলে আমার বোনকে রাত ১২টার সময় পলাশবাড়ী পাঠিয়ে দেবেন। ওখান থেকে আমাদের মাইক্রোবাস ঢাকায় নিয়ে যাবে।’

পলাশবাড়ী মানে গাইবান্ধা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে, সম্ভব নয়। মেয়েকে একা একা এত রাতে পাঠানো ঠিক হবে না। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, বড় ঝামেলায় পড়ে যাব। আমাদের ছেলে ঢাকার আইডিয়াল স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। বোনকে দেখার জন্য ছটফট করে। টিভির সামনে যায় আর আমাকে বলে, ‘আব্বু, কত গাড়ি তো যাওয়া-আসা করে। তুমি কেন পারো না।’ আমি বলি, আব্বু, এসব ঝামেলার কাজ। আমার ভালো লাগে না। এদিকে আমার স্ত্রী বলে, ‘ব্যবস্থা করতে না পারলে বাসা থেকে বের হয়ে আবদুল্লাহপুর যাব। মানুষ কেমনে যায়?’ আমি বলি, ট্রাকে করে গভীর রাতে যায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাদাগাদি করে কখনো কখনো ড্রামের মধ্যে বসে যায়, টিভিতে দেখো না? কিন্তু সে কান্না জুড়ে দেয়। আমার আর করার কিছুই থাকে না। আমিও মাঝেমধ্যে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদি। মেয়ের জন্য মনটা কাঁদে।

হঠাৎ ২৩ মে র‌্যাবের মহাপরিচালক ঘোষণা দিলেন, নিজ দায়িত্বে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাওয়া-আসা করা যাবে। আমার অল্প পরিচিত এক পরিবার এবং আমরা মিলে একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে সেদিনই বাড়িতে গেলাম। মা ও মেয়ের কাছে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আমরা আর আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না। গভীর রাতে মা আমাদের সবাইকে চাপকলের পানি দিয়ে গোসল করতে বললেন। সবাই গোসল করলাম।

চাপকলের পানিতে আমার ঠান্ডা লেগে কাশি হলো, শ্বাসপ্রশ্বাসেও একটু সমস্যা দেখা দিল। বাজারে নেবুলাইজার নিতে গেলে গ্রামের কিছু লোক কানাঘুষা শুরু করল, আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলো।

এর মধ্যে আমার কাছে জেলার করোনা নিয়ন্ত্রণ কক্ষসহ সরকারি-বেসরকারি দপ্তর থেকে ফোন আসা শুরু হলো। স্থানীয় থানা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় থেকেও বলা হলো, ‘কাল আপনি বাড়িতে থাকবেন।’ এ রকম অনেক ফোন। সবাই প্রশ্ন করে, জানতে চায়—কতজন এসেছেন, কার বাড়ি কোথায়, কোথা থেকে আসলেন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন, কিন্তু দরকারি কথা কেউ বলে না। আমার কী হয়েছে, কী লাগবে, চিকিৎসা বা ওষুধের প্রয়োজন আছে কি না।

যাঁরা কন্ট্রোল রুমে বসে আছেন, তাঁরাই যদি চিকিৎসার পরামর্শ দিতেন, তাহলে রোগীরা উপকৃত হতেন। পরামর্শ দিয়ে যদি সাহস জোগাতেন, তাহলেও ভালো হতো।

কোনো পরামর্শ কেউ দেয় না। এত তথ্যও বারবার দিতে পারি না। ভয়ে কাঁপতে থাকি। এর মধ্যে আমরা যে গাড়িতে এসেছি, সেটা বাদিয়াখালীর কোনো এক জায়গায় ছিল। বাড়ি থেকে ছয়-সাত কিলোমিটার হবে। ফোন দিলে সাড়া দেয়। অন্য একটা গাড়ি আমাকে ব্যবস্থা করে দেয়। তড়িঘড়ি করে ২৭ মে রাতেই আমরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিই। মা প্রতিবারের মতো এবারও তাঁর আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে দিয়ে বিদায় দেন, ‘বাবা, ভালো থাকিস, তোর কিছু হবে না।’

মায়েরা এমনই! মায়ের কান্না সন্তানের জন্য সারা জীবন থাকে। তাই মাকে সবাই ভালোবাসুন। রাত দুইটায় ঢাকায় পৌঁছাই। ভয়ে এদিক-সেদিক তাকাই। দুই-তিন মিনিটের মধ্যে পরিবার নিয়ে চারতলা বাসায় উঠে পড়ি। আমার অসুস্থতা আরও বেড়ে যায়।

১ জুন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পরীক্ষা করালে করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। আগেই পরিচিত ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা চলছিল। তারপর আমার অফিসের (প্রথম আলো) ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দুই বেলা কথা বলে চিকিৎসা চলে। এদিকে শুনতে পাই আমরা আসার একদিন পর গ্রামের বাড়িতে পুলিশ যায়। তবে বাড়ি লকডাউন করে না। কারণ, ভাইয়ের এক ছেলে পুলিশে চাকরি করে এবং সে তখন বাড়িতে ছিল। তারা সবাইকে বলে যায় ১৪ দিন বাড়িতে থাকতে। পুলিশ আসায় গ্রামে হইচই পড়ে যায়। সামাজিকভাবে আমাদের পরিবার হেয়প্রতিপন্ন হয়। হায় রে সমাজ! িকছু লোকের কারণে গ্রামের পর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে নানা কথা। আমাকে ফোন করে জানতে চান নিকটাত্মীয়রা। অনেক আত্মীয় সাহস দেন। অনেক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি দুই বেলা ফোন দিয়ে ভালো পরামর্শ দিয়েছেন। আনিসুল হক ভাই আমাকে প্রায়ই ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। বার্তা সম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছি ভাই পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা করেছেন। অফিসের প্রশাসন বিভাগ নিয়মিত আমার খোঁজখবর নিতে থাকে।

ঘিঞ্জি এলাকা মুগদায় প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর মাইকে মৃত্যুর সংবাদ ঘোষণা দিলে শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। অনেক দিন ঘুমাতে পারিনি। সারা রাত ঘণ্টায় ঘণ্টায় তাপমাত্রা মেপেছি। এভাবে ১০-১২ দিন চলার পর ১-২ ঘণ্টার জন্য ঘুম আসে। ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয়, একটু আরাম পাচ্ছি—আমি মনে হয় আলোর মুখ দেখতে পাব।

গ্রামের বাড়িতে আমার মাসহ পরিবারের ১৪-১৫ জন সদস্য থাকেন। প্রতিদিন সকালে ও রাতে শুধু বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা হতো, তিনিই মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের জানাতেন। ১২ জুন প্রথম ফোনটা মাকে দিয়ে বলি, মা, একটু আরাম পাচ্ছি। শুনেই বললেন, ‘হে আল্লাহ, রাহমানির রাহিম, তুমি মাফ করো, মাফ করনেওয়ালা আল্লাহ।’

দ্বিতীয় ফোনটা আনিসুল হক ভাইকে দিয়ে বলি, আমি মনে হয় আলোর মুখ দেখতে পাব। তিনি বললেন, ‘তুমি অবশ্যই আলোর মুখ দেখবে।’ অনেক পরামর্শ ও সাহস দেন।

১৪ জুন সম্পাদক মতিউর রহমান ফোন দিয়ে শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিলেন। কোনো কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করলেন। আমি বলি, ১৬ জুন টেস্টের ব্যবস্থা করবেন। তিনি বললেন, ‘বলে দিচ্ছি।’ পরে ফলের ঝুড়িও পাঠিয়ে দেন আমার বাসায়।

১৬ জুন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে পরীক্ষা করালে করোনা নেগেটিভ আসে। আল্লাহর রহমতে এবং মায়ের দোয়া ও সবার ভালোবাসায় আমি সুস্থ হয়ে উঠি।

৩১ মে মেয়ের এসএসসির রেজাল্ট হলো, জিপিএ-৫ পেল। খুশির খবরটা কাউকে জানানো হলো না। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে কীভাবে জানাব, তা ভুলে যাই। সবাই জানতে চায়, কিন্তু আমি বলতে পারি না।

ছোট ছেলে ফারদিন আহমেদ খুবই খেয়াল রাখে। অবাকই হই। ছোট্ট একটা বাসা, দুই ঘরের জন্য একটা বাথরুম, বাথরুমে যাওয়ার আগে ছেলে ব্লিচিং পাউডার ও জীবাণুনাশক স্প্রে করত। আর আসার পরও একই কাজ করত। কোনো কিছু চাইলেই মুহূর্তের মধ্যেই এনে দিত। মনে হয় সব দায়িত্ব তার ঘাড়ে। স্ত্রী ঘরে ও বাইরে সমানতালে সামলেছে। এ যুদ্ধে জয়ী হতেই হবে। মেয়েও আমার জন্য নানা কিছু করার চেষ্টা করেছে। অবশেষে আমার পরিবার করোনাকে হার মানিয়ে ছেড়েছে।

লেখক: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ অফিস সহকারী