
আমার নানু আয়েশা ফয়েজের কথা খুব মনে পড়ছে। ছোটবেলায় কয়েক বছর আমি আর আমার বড় বোন পিরোজপুর ছিলাম। একটা ‘শব্দ’ ছিল, ওটা শুনলে বুঝতাম নানু আসছেন। মাঝেমধ্যে মিলে যেত, মাঝেমধ্যে মিলত না। মিললে দেখতাম মণি খালাকে নিয়ে কালো ফ্রেমের চশমা পরে আমার নানু গেট খুলে ভেতরে ঢুকছেন। সে কী আনন্দ! আমি আর আমার বোন নানুর ব্যাগের পাশে গিয়ে বসতাম। নানু ব্যাগ থেকে নানা ধরনের চকলেট বের করে দিতেন। আবার আমরা যখন ঢাকা ছেড়ে পিরোজপুর চলে আসতাম। তখন দুই বোন গলা ছেড়ে কাঁদতাম। নানুর মুখের পান কাগজে মুড়িয়ে নিয়ে আসতাম। আচারের মতো জমিয়ে জমিয়ে খেতাম। কী দিন ছিল!
ঢাকায় এলে বড় মামা হুড়মায়ূন আহমেদের বাসায় উঠতাম। নানু বিকেলে আমাদের ছয় বোনকে (মামাতো, খালাতো মিলিয়ে) মাথায় তেল দিয়ে দিতেন। সে ছিল কঠিন এক তেল! জুলফি দিয়ে চুয়ে চুয়ে পরত। বেণি এমন টাইট হতো যে দুই চোখে পানি এসে যেত। দুই বেণি বাঁধা শেষ হলে আমরা আয়নার সামনে গিয়ে জুলফির তেলটুকু মুছে হাতে মেখে ফেলতাম।
কোনো পরীক্ষা বা চাকরির ইন্টারভিউ এলে নানুকে দোয়ার জন্য বলা হতো। নানুর দোয়া আমাদের ভরসা দিত।
আমার দেখা বুদ্ধিমান ১০ জন মানুষের মধ্যে নানু একজন। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। নানু আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁকে ফোন দিলাম। নানু ফোন ধরে কিছু শুনছিলেন না। আমি চিন্তা করব দেখে নানু বললেন, ‘অমি নানা, আমি শুনছি না। কিন্তু ভালো আছি। চিন্তা কোরো না।’
নানু ২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর চলে গেলেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে। সেই দিন নীষা ফোন দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘অমি আপু, নানু মারা যাচ্ছে। আমরা হাসপাতালে।’ আমি হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ফোন ধরে আছি। আমি কিছু করতে পারছি না। নানুকে দেখতে পারছি না। ইশ, কী যে এক কষ্ট দূরে থাকার! পরদিন যখন দাফন করার জন্য নানুকে নেওয়া হচ্ছিল, ঠিক সে সময় আমার এত অস্থির লাগছিল যে বলে বোঝাতে পারব না। আমি আবার ছোট বোনকে ফোন দিই। নীষা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘অমি আপু, নানুকে নেওয়া হচ্ছে।’ আচ্ছা, আমি হাজার মাইল থেকে কীভাবে বুঝলাম নানুকে চিরবিদায় জানানো হচ্ছে!
আসার আগে নানু আমাকে বলেছিলেন, ‘আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না নানা। আমার দীর্ঘ আয়ু।’ নানু, আপনি আপনার কথা না রেখেই চলে গেলেন। নানু, এই কালে আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হলো না, পরকালে দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: আয়েশা ফয়েজের নাতনি