আমার বৃষ্টি ভেজা ঈদ
২০০৩ সাল। আমি তখন অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র। কিছুদিন আগেই আব্বার বদলির কারণে আমরা কুমারখালি (কুষ্টিয়ার একটা থানা) থেকে কুষ্টিয়া চলে এসেছি সপরিবারে। কুষ্টিয়ায় চলে এলে কি হবে-মনটা সারাক্ষণ ছোটবেলার স্কুলের বন্ধুদের জন্য অস্থির হয়ে থাকত। এমনই এক সময়ে চলে এল ঈদুল আজহা। তখন মার্চ মাস-রাতের বেলায়ও হালকা শীত থাকত। ঈদের আগের দিন মনটা খুবই খারাপ। কুমারখালী যাওয়ার জন্য মনটা অস্থির। আব্বা প্রতিবারের মতো আগেই দাদা বাড়িতে চলে গেছেন। সন্ধ্যার পর বড় ও মেজো ভাইকে কোথাও না পেয়ে নিশ্চিত হলাম ওরাও কুমারখালীতে গেছে। মনটা আরও ব্যাকুল হয়ে উঠল। আমি মাকে কুমারখালী যাওয়ার কথা বললাম। মা বলল তুই এখনো ছোট-এত রাতে কুমারখালী যেতে হবে না। তখন শুধুই ভাবছি কীভাবে আমি কুমারখালী যাব। রাত আটটার দিকে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম-মাকে না জানিয়ে যাব। তাই ছোট ভাইকে বললাম-আমি যাওয়ার এক ঘণ্টা পরে মাকে বলিস।
কাছে ছিল মাত্র ১৮ টাকা। কেউ-ই তো ঈদের সালামি দেয়নি। রাত ৮টা ৫ মিনিটে ট্রেন। মিস করা যাবে না। প্রকৃতি সবদিক থেকেই আমার বিপক্ষে ছিল সেদিন। ট্রেন মিস করলাম। রিকশায় চড়ে বাস স্ট্যান্ডে গেলাম। রিকশা থেকে নামব। এমন সময় রিকশাওয়ালা মামা বলল-তুমি কি কুমারখালী যাবে? আমি বললাম হ্যাঁ। রিকশাওয়ালা মামা বলল-আমার বাড়িও কুমারখালী, তুমি আমার রিকশায় যেতে পারো। ভাড়া লাগবে ১২ টাকা। আমি তো মহাখুশি। বললাম মামা চলেন।
কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ আকাশে ঝোড়ো মেঘ জমতে শুরু করল, সেই সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাস। ঠান্ডার পরিমাণও অনেক বেড়ে গেল। আকাশ এমন কালো হয়ে এল যে, আমি বুঝতে পারছি না আরও সামনের দিকে যাওয়া ঠিক হবে কি না। কারণ সামনে গড়াই নদী। চারদিকে শুধুই বালি আর বালি মাঝে সামান্য একটু পানিতে আছে নৌকা পারাপারের ব্যবস্থা। যা হোক সাহস নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে বললাম রিকশাওয়ালা মামাকে। কিন্তু আকাশ আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করল। প্রবল বাতাস ও বৃষ্টি। নদীর কাছে পৌঁছানোর আগেই তু-ফা-ন শুরু হয়ে গেল। তখন সময় রাত আনুমানিক পৌনে দশটা। মনে মনে ভাবছি চাঁদরাতের পিকনিকের কি হবে?
কোনো রকমে ভিজে ভিজে নির্মাণাধীন ব্রিজের একটা পিলারের নিচে আশ্রয় নিলাম। ওখানে একটা ছোট্ট দোকান ছিল। আরও দুজন লোক ছিল সেখানে। চারদিকে অন্ধকার আর দোকানে এক চিলতে হারিকেনের আলো। থেমে থেমে বিকট আওয়াজ করে বজ্রপাত। শীত ও বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডায় কাঁপুনি ধরার মতো অবস্থা। তবুও মনোবল আগের মতোই-কুমারখালী যেতেই হবে। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ঝড়-বৃষ্টি কমলে আবার যাত্রা শুরু করলাম রিকশাওয়ালার সঙ্গে। অনেক কষ্ট করে নদী পার হয়ে রাস্তায় উঠে পড়লাম। রাস্তার অনেক জায়গায় গাছের ডাল ভেঙে পড়ার কারণে চলতে কষ্ট হচ্ছিল। আরও ঘণ্টাখানেক চলার পর অবশেষে কাঁপতে কাঁপতে কুমারখালীতে পৌঁছালাম রাত ১২টার পর।
এবার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। বন্ধুরা সবাই ঝড়-বৃষ্টির কারণে যার যার বাসায়। নিজেই নিজের মনটাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। চোখের পানিও আর ধরে রাখতে পারলাম না। এত রাতে এখন কোথায় যাব? ভাবছি …
কিছুটা দূরেই আমার এক বন্ধুর লন্ড্রির দোকান। ঈদের জন্য ও এত রাতেও খোলা রেখেছিল। ও আমাকে দেখামাত্র গরম কাপড় দিল। পাউরুটি ও কলা খেতে দিল। দোকানের এক কোনায় বিছানা করে লেপের নিচে ঘুমাতে দিল। বেশি শীত করছিল বলে ও গরম স্ত্রী লেপের ওপর দিয়ে সেঁক দিয়েছিল। ঘুম …
ভোরের আকাশ পরিষ্কার হলে আমি আবার কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিই। আমি চেয়েছিলাম এই রকম ঈদ…