আমার বোন একদিন অলিম্পিয়ায় যাবে

শরীর গঠনে ভাই রায়হানুর রহমানই অহনা রহমানের কোচ। ছবি: কবির হোসেন
শরীর গঠনে ভাই রায়হানুর রহমানই অহনা রহমানের কোচ। ছবি: কবির হোসেন

শুধু পুরুষেরাই কেন, মেয়েরাও তো হতে পারে বডিবিল্ডার। এমন চিন্তা থেকে গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ বডিবিল্ডিং ফেডারেশন আয়োজন করে মেয়েদের জাতীয় শরীর গঠন চ্যাম্পিয়নশিপ। প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় অহনা রহমান, আমার ছোট বোন।

অহনার জন্মের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আম্মুকে অস্ত্রোপচার কক্ষে ঢোকানো হলো। খানিক পর দেখি ফুটফুটে একটা মেয়েকে কোলে তুলে দাদি আমাদের সামনে নিয়ে এলেন। আমি দাদিকে বললাম, ‘বোনকে কোলে নেব।’ দাদি বললেন, ‘তুমি নিয়ো না। হাত থেকে পড়ে যাবে।’ তুলতুলে, সুন্দর পুতুলের মতো বাবুটার দিকে আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। সেই অহনা এখন কত বড় হয়ে গেছে! বাংলাদেশের শরীর গঠনের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।

আমি একজন পেশাদার বডিবিল্ডার। জাতীয় প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ জিতেছি। মিস্টার মার্সেল বডিবিল্ডিং চ্যাম্পিয়নশিপে জিতেছি শিরোপা। ঢাকার লালবাগে একটা ব্যায়ামাগার ও ফিটনেস সেন্টার তৈরি করেছি। আমাকে দেখে অহনা শরীরচর্চায় আগ্রহী হয়। সঙ্গে আসত অহনার বান্ধবী তাসনিয়া সিদ্দিক। যখন বডিবিল্ডিং ফেডারেশন ঘোষণা দেয় মেয়েদের জাতীয় প্রতিযোগিতা হবে, অহনাকে মজা করে জিজ্ঞাসা  করলাম, ‘অংশ নিবি?’ অহনা রাজি হলো।

প্রায় দেড় বছর ধরে ও আমার সঙ্গে শরীরচর্চা করে। তাই মনে হয়েছিল, ওর শারীরিক গড়ন এই প্রতিযোগিতার উপযোগী। তা ছাড়া শরীর গঠনের প্রতি সে নিবেদিত। এসব দেখে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিই, সঠিক নিয়মে ওকে কোচিং করাতে শুরু করি। কিন্তু অহনা যে প্রথমবার অংশ নিয়েই চ্যাম্পিয়ন হবে, আমরা কেউ ভাবিনি।

বডিবিল্ডিংয়ে অহনার আসার ব্যাপারে আব্বু-আম্মু কখনো বাধা দেননি। যেহেতু আমি এই অঙ্গনে আগে থেকেই আছি, তাই সব বাধা পার করে এসেছি। তবে এটা সত্যি, এখনো মেয়েদের শরীর গঠন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নিষিদ্ধ একটা ব্যাপারের মতো। বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজে আছে নানা বাধা। পোশাকের বেলায় সচেতন ছিল ফেডারেশন। তা ছাড়া আমি ওকে সমর্থন দিয়েছি। আমার বিশ্বাস ছিল, ও পারবে। কারণ, ছোটবেলা থেকেই অহনা ফুটবল খেলে। ব্যাডমিন্টন খেলে। নাচে, ছবি আঁকে, স্ক্র্যাপ বুক করে। সুডোকু মেলায়। পড়াশোনাতেও ভালো। বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে।

আমার ছোট বোনটিকে নিয়ে গণমাধ্যমে খবর ছাপা হচ্ছে। টেলিভিশন চ্যানেল ওর সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। কিছুদিন আগে প্রথম আলো অহনাকে নিয়ে একটা ভিডিও চিত্র তৈরি করেছে, যেটা সাড়া ফেলেছে খুব। সেদিন এক ছোট ভাই বলল, ‘ভাই, আপনার বোন যতটা ভাইরাল হয়েছে, আপনি ততটা হতে পারেননি।’ কিন্তু এই যে সবাই ওকে চিনছে, এটাই আমার প্রাপ্তি। ও আমার মেয়ের মতো। আমার যদি মেয়ে থাকত, চাইতাম সে-ও আমার চেয়ে বড় কিছু করবে। কখনো মিস্টার বাংলাদেশ হতে পারিনি বলে আমার একটা অপূর্ণতা আছে। কিন্তু অহনা একবার জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েই বাজিমাত করেছে। স্বপ্ন দেখি, আমার বোন একদিন অলিম্পিয়ায় (আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ আসর) খেলবে। ওকে সব সময় বলি, ‘যেখানেও যাও, তোমার সেরাটা দিয়ো।’

আমরা পিঠাপিঠি ভাইবোন। কিন্তু কখনো খুনসুটি হয় না। ঝগড়া হয় না। দুজন বন্ধুর মতো। সবকিছু নিজেদের মধ্যে ভাগ করি। বাইরে আড্ডা দেওয়া একদমই পছন্দ না আমাদের।

যেকোনো খেলায় কোচের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি একাধারে অহনার ভাই ও কোচ। আটবারের চ্যাম্পিয়ন মিস্টার অলিম্পিয়ারও কোচ আছে। বডিবিল্ডিং এমন একটা খেলা, যেখানে প্রতি ঘণ্টায় শরীর বদলে যেতে পারে। তাই অহনাকেও খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে হয় কঠোরভাবে। বডিবিল্ডিংয়ের ভাষায় বিষয়টিকে ‘প্রোটোকল’ বলা হয়। ডায়েট, ওয়ার্কআউট, সবকিছুর পরিকল্পনা ওকে আমিই তৈরি করে দিই। ওর যখন কোনো প্রতিযোগিতা থাকে, তখন বেশি করে ডায়েট করতে বলি। এখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করতে হচ্ছে। এ জন্য একটু ছাড় দিয়েছি ডায়েটে।

আমার বোন বলেই বলছি না, অহনার মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা আছে। সম্ভাবনা আছে আমাদের মেয়েদের বডিবিল্ডিংয়েও। এবার তো ৩৫ জন মেয়ে অংশ নিয়েছে জাতীয় প্রতিযোগিতায়। সবার মধ্যে প্রচুর আগ্রহ দেখেছি। প্রচুর সাড়া দেখেছি। এটাকে ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত। সবাইকে উৎসাহিত করা উচিত। বডিবিল্ডিং একটা অপ্রচলিত খেলা। অহনার সুবাদে এটা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, ভাবতেই ভালো লাগে।

অহনাকে দেখে মাঝেমধ্যে একটা কথা ভাবি। ওর জায়গায় আমি থাকলে হয়তো কখনোই এতটা পারতাম না। জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পরই বলেছিল, ‘আমি পরীক্ষার জন্য পড়ালেখায় মনোযোগ দেব।’ সে কিন্তু তা-ই করেছে। ব্যায়াম শেষে বন্ধুরা যখন গল্প করি, সেখানে ও থাকে না। পড়তে চলে যায়। কখন কোথায় মনোযোগ দিতে হবে, সেটা ও ভালোই বোঝে। নিজের লক্ষ্যের দিকে কীভাবে এগোতে হয়, আমার বোন জানে।

লেখক: জাতীয় পর্যায়ের পেশাদার বডিবিল্ডার