আমার ভাই

মা ছাড়া বেঁচে থাকা যায় না।

আমার আপন চাচাতো ভাই, বয়সে আমরা দু-এক মাসের ছোট হব। ওর নাম মেহেদী আর আমার নাম নাঈম। ছয় বছর বয়সে ওর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা, কারণ ওর জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানে। সপরিবারে ওরা বাংলাদেশে এসে পড়ে। আমার কোনো ভাই নেই। আমি অনেক বলতাম মাকে, ‘আমার একটি ভাই এনে দাও।’ ও বাংলাদেশে আসার পর মা আমাকে বলেছিল, ‘তুই তো একটি ভাই চেয়েছিলি, এই নে ও তোর ভাই।’
ও পাকিস্তানি হওয়ায় ওর কথা কিছু বুঝতাম না। ওর একটি ছোট বোন ছিল, ওর মা-বাবা-বোন গ্রামে চলে যায় আর ওকে আমার সঙ্গে খেলার জন্য ঢাকায় রেখে যায়। আমরা একসঙ্গে গেলে সবাই যমজ ভাই বলত। আমার বাবা-মা ওকে আমার চেয়েও অনেক ভালোবাসত। আমি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রতি আমার ক্ষোভ জন্ম নেয়। আমার মা-বাবা কেন ওরে এত আদর করবে? ও তো আমার আপন ভাই নয়। ওর আর আমার একই রকম কাপড় কেন দেবে। ও তো আমার ভাই না। অনেক মারামারি করতাম, মা-বাবা অনেক বোঝাত। কিন্তু সমবয়সী হওয়ায় আমি ওর সঙ্গে লেগে থাকতাম, মারধর করতাম। ও আমার চেয়ে বড় অথচ আমি ওকে তুই বলে ডাকতাম আর ও আমাকে তুমি করে বলত। ও আমার চেয়ে বড় হওয়ায় ওকে ক্লাস টু আর আমাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করায়।

এ সময় ওর বাবা বিদেশ পাড়ি জমান। এর কিছুদিন পর ওর মা কেন কিছু না বলেই ওর ছোট বোনকে নিয়ে কোথায় যেন চলে যান। ও ওর মায়ের জন্য অনেক কাঁদত, আর আমি তো কোনো দয়ামায়া না দেখিয়ে ওর সঙ্গে সারাক্ষণ লেগে থাকতাম। মা-বাবা আমাকে অনেক বোঝাত কিন্তু আমি একই কাজ করে থাকতাম। ওর পড়াশোনার খরচ ওর বাবা দিতেন। একটা সময় ওর বাবা বললেন, আর টাকা দেবে না। আমার বাবা স্বল্প আয়ের চাকরিজীবী, আমার মা বললেন, টাকা না পাঠালে ওর পড়াশোনার খরচ দেবে কে? তখন ওর বাবা বলল, ‘বাড়ি পাঠাই দেন, ওইখানে ওর দাদির সঙ্গে থাকবে। পড়াশোনারও খরচ লাগবে না, সরকারি স্কুলে পড়বে। তখন ওরে বাড়িতে পাঠিয়ে দিই আমরা। কিন্তু ও বাড়িতে থাকতে পারত না। ওর মা নেই। এখানে আমার মাকে ও মায়ের মতো দেখত। ওর ওখানে মন টিকত না। ও ঢাকায় আসতে চাইত। আমি ওর সঙ্গে মারামারি করতাম বলে মা আসতে না করত, আমার বাবার ওর জন্য আলাদা মায়া ছিল, বাবা ওকে এখানে রাখতে চাইত। আমার জন্য আর পারেনি। ওর বাবা দেশে এলে বিয়ে করেন। ওর কথা চিন্তা করে বিয়ে করেন। কিছুদিন যেতে না যেতে ওর সৎমা কালসাপ হয়ে ওঠে। ওরে ওর বাবার কাছে মিথ্যা কথা বলে খারাপ বানায়। পরে ওরে মাদ্রাসায় ভর্তি করায়। সেখানেও ওর মন টেকে না। পরে ওকে আমাদের বাসায় এনে একটি ইলেকট্রনিক দোকানে কাজ শেখানোর জন্য দেওয়া হয়। তখনো আমি ওর সঙ্গে একই আচরণ করতাম।
মা দেখতেন, ওর জন্য আমি বাবার কাছে বকাঝকা খেতাম। পরে আমার পড়ার ক্ষতি হবে বলে ওকে আর আমরা রাখলাম না। গ্রামের একজন ওকে একটি দোকানে কাজ দেন। কিছুদিন কাজ করতে না করতেই আবার আমাদের এখানে এসে পড়ে। পরে বাবা ওর জন্য একটি কাজ ঠিক করে। মালিকের বাসায় থাকাখাওয়া করত। আর আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলে অনেক কিছু খেয়ে আসতাম। ওর সবচেয়ে আপনজন আমি ছিলাম, কিন্তু ওকে আমি পর ভাবতাম। আমার জন্য ওর মায়াটা আমি বুঝতে শুরু করলাম। ওর জীবনে যে কত যন্ত্রণা, তা আমার সঙ্গে শেয়ার করল। ওর যে মা নেই, এটা ওকে অনেক কাঁদায়। সিনেমায় যখন দেখত মা মরে গেছে, তখন ওর মায়ের কথা মনে করে অনেক কাঁদত। এ দুঃখ নিয়ে অনেকবার নিজে নিজে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যায়, ও একদিন আমাকে বলল, ট্রাকের নিচে জীবন দিতে চেয়েছিল। এর কিছুদিন পর ও ঢাকার চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে যায়, ওর বাবা বলে, গ্রামে কিছুদিন থাকো, তোমাকে বিদেশ পাঠাব। ওর জন্য পাসপোর্ট বানাল, মেডিকেল টেস্ট দিল। সবাই বলল যে আল্লাহ আল্লাহ করে বিদেশ গেলে জীবনটা পাল্টে যাবে। নামাজ পড়া শুরু করল। একটি কথা বলতে ভুলে গেছি, গ্রামে থাকাকালীন ওর সৎমা নানা ধরনের অপবাদ দিত। ওরে চোর বানাত সবার কাছে। ওর একটি বোন হয়, ও অনেক আদর করত, কয়েক বছর পর একটি ভাইও হয় ওর। ওর অনেক মায়া ছিল। সবাইকে অনেক আপন করে নিত। কিন্তু কেউ ওকে আপন করে নেয়নি। আমার বাবা ওরে খুব ভালোবাসত, কিন্তু আমাদের জন্য পারেনি।
বিদেশ চলে যাবে, তাই ও বাড়িতে থাকে নামাজ-কালাম শুরু করে, ওর ছোট ভাইটির বয়স তখন তিন মাস প্রায়। একদিন আমাকে কল দিয়ে বলল ঢাকায় আসবে। আমি বললাম, ঠিক আছে আয়। আসার আগে ওর বন্ধুদের থেকে কিছু টাকা নিয়ে নিজের জন্য কিছু কেনে। যেদিন আসবে, সকালে বাবার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে পুকুরপাড়ে এসে বসে। এর কিছুক্ষণ পর দাদির কাছে এসে মাফ চায়, বমি করা শুরু করে, দাদি বুঝতে পারল ও বিষজাতীয় কিছু খেয়েছে।
আর ওর আমার কাছে আসা হলো না। আমাকেই যেতে হলো ওর লাশ বহন করে কবরে নিতে। ওর আমার প্রতি ভালোবাসার মূল্য দেওয়ার আর সময় দিল না। ওর জীবনে সুখ বলে কিছু পেল না। সবাই দোয়া করবেন, আমার ভাইটি যেন ওই দুনিয়ায় ভালো থাকে। আমি আমার ভাইয়ের মর্যাদা দিতে পারিনি, তাই চলে গেল না-ফেরার দেশে।