
দুই দম্পতির দুই ছবি। পারভীন আর সবুজের আট বছরের সংসার। দুজনেই চাকরিজীবী। পারভীন বেশ ভোরে বেরিয়ে ফেরেন বিকেলে। এসে রান্নাবান্না। ঘরকন্না। ফ্ল্যাটে গৃহকর্মী নেই। পারভীনের হাতেই ঘরদোর সাজানো সুন্দর সংসার। সবুজও কিন্তু কম যান না। একটু দেরিতে অফিস পৌঁছালেও চলে। নাশতাটা নিজ হাতেই বানিয়ে খান। আধোয়া প্লেট আর পাতিল ধুয়ে রেখে যান। বউয়ের জন্য কোনো কাজ ফেলে রাখেন না। সকালে কাঁচাবাজার নিত্য-সওদাপাতি করে যান। টুকটাক কোনো কিছু বাদ পড়লে স্ত্রীকে মুঠোফোনে জানান। আচারের জন্য সর্ষের তেল কিংবা মধু, তরল দুধ পারভীন সানন্দে নিয়ে ফেরেন।
মুকাম্মেল ও মৌসুমি। তাঁদের ১২ বছরের সংসার। টাকাপয়সার টানাপোড়েন নেই। দুজনেই বড় চাকরি করেন। মৌসুমির অফিসের চাপ, সংসারেও কাজের শেষ নেই। তাঁর হাতের রান্না ছাড়া স্বামী বেচারা খাবেই না। রাতের খাবারসহ নাশতাটাও করতে হয় তাঁকেই। বাসাটা অফিসের কাছে বলে রক্ষা। দুপুরের খাবার দুজনেই তা অফিসে সারেন। শপিংমলে সাপ্তাহিক বাজার, শ্বশুরবাড়ি থেকে একমাত্র পুত্রকে আনা, ঘরকন্নার সব কাজ একা স্ত্রীকেই করতে হয়। মুকাম্মেলকে যদি এক প্যাকেট দুধ আনতে বলা হয়, ‘ওরে বাবা! এসব আবার পুরুষেরা করে নাকি!’ নাবালক পুত্রকে এখনই সে বড় করছে এই বলে—‘ভুলেও রান্নাঘরে যাবি না। মেয়েদের কাজ ছেলেদের একদম করতে নেই।’ বউকে শোনাতেই বলা। মৌসুমি এসব নিয়ে একদম পেরেশান।
কোন কাজটা মেয়েদের, আর কোনটা পুরুষের—এ নিয়ে বেহুদা তর্কের অবসান ঘটেনি আজও। রান্নাবান্না, ঘরের কাজ, হেঁশেলের কাজ করলে পুরুষের ইজ্জত যাবে—এমন ধারণা থেকে মুক্ত নই আমরা অনেকেই। তারপরও বলিউড অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন যেমনটা বলেছেন, ‘জীবন জটিল নয়। আপনি আমি যেভাবে চাইব, জীবন সেভাবেই বদলাবে।’
তা না হলে কর্মজীবী নারীর বিশ্রাম নেওয়ার সময় কোথায়? নিজের জন্য সময় কই?
২.
চারপাশে মাঝেমধ্যেই বেশ কৌতুককর দৃশ্য উপভোগ করি আমরা। বিদেশ থেকে এসেছে বন্ধু দম্পতি। পুরুষটি একগাল হেসে সবার সামনেই বলল, ‘দেশে এ কয়েক দিন বড্ড বাঁচা বাঁচব। আর যাই হোক, থালাবাসন তো ধুতে হবে না। ওয়াশিং মেশিনে পাউডার ঢালো, কাপড় দাও, ওহ! এখন গিন্নি আর ফালতু সব কাজ ধরিয়ে দিতে পারবে না। অন্যের আধোয়া প্লেট ধোয়া, ভাবলেই যেন তাঁর গা গুলিয়ে যায়। উফ! অত ভোরবেলা গাড়ি চালিয়ে মেয়েকে স্কুলে নেওয়া—সবকিছু থেকে মুক্তি। এ কয়েক দিন শুধু ঘুম।
কি অদ্ভুত স্ববিরোধী মানসিকতা আমাদের। লন্ডনে বসে যে কাজটা করতে কোনো আলসেমি চলে না, সে কাজটাই দেশে এলেই ফালতু মেয়েদের কাজ হয়ে যাচ্ছে।
লন্ডন বা সিডনি, ঢাকা কি বরিশাল—একই তো বাঙালি সংসার। যে কাজ বিদেশে বসে স্ত্রী-কন্যাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে করছি, চমৎকার বোঝাপড়া নিয়ে করছি, সেটি দেশে বসে করলে সম্মান থাকবে না, এমনটা কেন! কাজকর্ম সবই তো সংসারের সুখের জন্য। এই সুখ জটিল কোনো বিষয় নয়। নিজের মনের পুরোনো ধ্যানধারণা বদলে নিলেই জগৎটাও বদলে যায়।

ছেলে হোক, মেয়ে হোক—কাজ জানাটাই আসল কথা। কাজ জানা মর্যাদার। সংসারের খুঁটিনাটি সব কাজ। ব্যাংকে টাকা তোলা, বিল জমা, সন্তানের বেতন, স্কুলে নেওয়া আসা-কোনো কাজই ফেলনা নয়।
একজন কর্মজীবী নারীর জীবন বর্ণাঢ্য কর্মময়। অফিসের পাশাপাশি ঘর নামক প্রতিষ্ঠানও সামলাতে হয়। যত যাই বলি, রান্নায় নারীর একতরফা রাজত্বের এখনো অবসান ঘটানো যায়নি। স্ত্রী যদি মস্ত কর্মকর্তাও হন, তাঁর স্বামী, শ্বশুরবাড়ির পরিবার আবদার করবেই—বউয়ের রান্না না খেলে খাবার হজম হয় না। সন্তানেরাও মায়ের হাতের গাজরের হালুয়া, আলু দিয়ে নদীর কই মাছ রান্না খুব পছন্দ করে। কর্মজীবী নারীকে এসব ফরমাশ না মেটালে চলে না।
এতে সংসারের হারমনি নষ্ট হয়। কোনো নারীই সেটা চাইবেন না। তিনি চার হাতের কাজ একাই করতে উদ্যোগী বেশির ভাগ সংসারে। আর তাই মা কিংবা বধূ হিসেবে এ দেশের শ্যামল রং রমণীর সুনাম আজও অম্লান।
কিন্তু নারীকে একের ভেতরে দশ ভাবলে চলবে না। কর্মজীবী নারী কে নন। যিনি কোনো প্রতিষ্ঠানের বেতনভুক কর্মচারী নন, শুধু পড়ে থাকেন ঘরসংসার নিয়ে তাকে কর্মজীবী না ভাবাটা মস্ত অন্যায়।
ফেসবুকে একটা ছবি দেখতে পেলাম একবার। নারীর ছবি। মাত্র দুটি হাত। সে হাতে ঘর লেপছেন, রান্না করছেন, গর্ভে সন্তান ধারণ করছেন, সন্তানকে স্নান করাচ্ছেন, উঠোনে ফসল শুকোচ্ছেন, কাপড় ধুচ্ছেন, আলপনা আঁকছেন, ঘরের চালে আচার আর কাপড়চোপড় দিচ্ছেন, মাছ কুটছেন, হাঁস-মুরগি-গরু পালন করছেন, মাঠে যাওয়া স্বামীর জন্য খাবারের পুটুলি হাতে তুলে দিচ্ছেন, অসুস্থ প্রিয়জনের সেবা করছেন—
এ যেন চিরচেনা নারীর ছবি। সবাই আমরা মা বা স্ত্রী হিসেবে এমন এক নারীর ছবি হৃদয়ে সযত্নে জমিয়ে রাখি।

এমন নারী কর্মজীবী নয় তো কর্মজীবী কে। এই নারী একাই দশজন। কিন্তু অতীতে নারী দশ হাতে কাজ করেছেন বলে এখনো কি তা সম্ভব। জীবনযাপনের পদ্ধতি বদলেছে। নারী শুধু সংসারের চার দেয়ালের মধ্যেও আবদ্ধ নন।
‘চার দেয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে/সাজিয়ে নিয়ে দেখি বাহির বিশ্বকে।’ হ্যাঁ, নারী এখন চার দেয়ালের মধ্যের সংসারকে যেমন সামলাচ্ছেন। তেমনি সেই সংসার সাজিয়ে বাইরের বিশ্বেও পা রেখেছেন। সাফল্যের সঙ্গে সব কাজে অংশও নিচ্ছেন। তাই তাঁর পাশে দাঁড়ানো সংসারের সবার দায়িত্বের মধ্যে বর্তায়। একজন গৃহিণী সংসারী নারী যেমন তেমনি কর্মজীবী নারীও সবার জন্য, সুখের জন্য, উন্নয়নের জন্য, মানবিক সাংসারিক প্রশান্তির জন্য ঘরে-বাইরে কাজ করেন। কেন আমরা সবাই মিলে তাঁর পাশে দাঁড়াব না।
কী করণীয়
* স্বামী তাঁর অফিসের আগে বা পরে সংসারের তথা ঘরের নানা খুঁটিনাটি কাজ ভাগ করে নিতে পারেন।
* ছেলেমেয়েদের জেন্ডার নির্বিশেষে ঘর গোছানোর কাজ, রান্নাবান্না, কাপড়চোপড় ঠিক রাখার কাজ শেখানো দরকার। কাজে অনাগ্রহী নয়। বরং কাজে স্বনির্ভর করে তোলা উচিত।
* দেশের অর্থনৈতিক চালচিত্র বদলাচ্ছে। আরও বদলাবে। আজকাল গৃহকর্মী পাওয়াও খুব কঠিন। তাই নিত্য-গেরস্থালির অনেক কাজ নিকট ভবিষ্যতে নিজ উদ্যোগেই করতে হবে।
* ভাবনার বদল দরকার। আর সেটার জন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী সংসার পরিকল্পনা। নিজের কাজ নিজে করলে ছোট হয় না কেউ—এই চেতনাকে ‘সংসার সুখের’ মন্ত্র হিসেবে ছড়িয়ে দিতে হবে।
সুলতানা আলগিন : সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।