আর কোনো টুকি যেন মা না হারায়

ছবির এই রাজ্যে যোগ হয়েছে রাজকন্যা, তবে চিরতরে হারিয়ে গেছে রানি
রিফাতের পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

অসুস্থ থাকার সময় দেখতে গেলে রিফাত সুলতানা জানিয়েছিলেন, অনাগত সন্তান টুকির জন্য ঘুমাতে পারেন না। আমি বলেছিলাম, ‘আপু আর কটা দিন সহ্য করো।’ প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আর সহ্য! টুকি আসুক তারপর রুদ্র, ধ্রুব, টুকি—তিনজনকে তোদের কাছে দিয়েই আমি চলে যাব।’

অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, রিফাতের বলা শেষ কথাটাই এখন সত্য। আমার ‘রিফাত আপু’; বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সহযোগী প্রযোজক রিফাত সুলতানা ১৬ এপ্রিল সকালে টুকিকে জন্ম দিয়ে বিকেলে চলে গেলেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে।

ফ্ল্যাশব্যাক: এপ্রিল ২০২০: রাজধানীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভর্তির আশায় রাতভর ছুটে বেরিয়েছেন এক গর্ভবতী নারীসহ চারজন করোনায় আক্রান্ত রোগী। দুটি হাসপাতাল ফিরিয়ে দেওয়ার পর শেষ পর্যন্ত একটি সংবাদভিত্তিক চ্যানেল ও একজন চিকিৎসকের সহায়তায় তাঁদের তৃতীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। সকাল পর্যন্ত নার্সদের দেওয়া একটি বেডশিটে শুধু শুয়ে থাকা।

জুলাই ২০২০: বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে চারটি হাসপাতাল ঘুরলেন। কোনো হাসপাতাল ভর্তি নিল না। আলোর মুখ দেখতে পেল না সেই সন্তান।

দুঃখের বিষয়, এক বছরে করোনায় আক্রান্ত অন্তঃসত্ত্বা নারীদের চিকিৎসার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ চেখে পড়েনি। নয়তো রিফাতকে এভাবে হারিয়ে যেতে হতো না। অন্যদের তুলনায় একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর যখন সবচেয়ে বেশি মানসিক প্রশান্তি কাম্য, সেখানে উল্টো এ সময়ে তাঁদের সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় ভুগতে হয়েছে অনাগত সন্তানের জন্য। মানসিক চাপ আর চিকিৎসা না পাওয়ার ভয়টা জেঁকে বসেছে অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর।

রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে যদি করোনায় আক্রান্ত কোনো অন্তঃসত্ত্বা নারী চিকিৎসা না পেয়ে থাকেন, তবে একটু পিছিয়ে থাকা দেশের অন্য স্থানগুলোর অবস্থা চোখ বন্ধ করে ভাবলে শিউরে ওঠার মতোই। করোনায় আক্রান্ত বা সুস্থ অন্তঃসত্ত্বা নারীর চিকিৎসায় সরকারের আলাদা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল বহু আগেই।

রিফাতের চিকিৎসার জন্য ঢাকার বেশ কটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপের কারণে দেখেছি কোথাও শয্যাসংকট, কোথাও অক্সিজেন স্বল্পতা, কোথাও নিজেদের রোগীর বাইরে অন্য রোগী ভর্তি না করার দৃশ্য। এসব দৃশ্য তো আমাদের কোনোভাবেই কাম্য নয়।

রুদ্র, ধ্রুব আর টুকির জন্য

আমি রিফাত ও তাঁর স্বামী নাজমুল ইসলামের একসময়ের সহকর্মী। দুই পরিবারেই আমি মেয়ে হিসেবে গণ্য। সেই সুবাদে আড়াই বছরের রুদ্র ও ধ্রুব, আর এখন নবজাতক টুকির ‘ফুলা-মা’। তাই বাচ্চারা আজ মাতৃহারা হলেও মা ছাড়া নয়।

২০১২ সালে থেকেই রিফাতের সঙ্গে পরিচয়। ধীরে ধীরে আমরা হয়ে উঠেছি বোন-বন্ধু। বড় ভাই ও বোন হিসেবে নাজমুল ও রিফাত সব সময় আমার পাশে ছিল কিন্তু ছোট বোন হিসেবে শেষ সময়ে ব্যর্থ আমি, আমরা ব্যর্থ হয়ে গেলাম। কিন্তু আমি হার মানছি না। টুকিকে নিয়ে আমার ঘরে ফেরার চেষ্টার সংগ্রাম এখনো চলছে।

আমরা চার বোন আর ভাইয়া যখন গল্পে বসতাম আমি বলতাম টুকি আমার, আর আজ আমার সেই বড় বোন নিঃস্বার্থভাবে টুকিকে আমার কোলে তুলে দিয়ে চলে গেল।

রিফাত হয়তো জানতেন, যে ওঁকে যেতে হবে। তাই ওর তিন সন্তানকে তিনজন মায়ের হাতে তুলে দিয়ে গেছে।

জন্মদাত্রীকে হারালেও আমরা তাদের মাতৃসম খালামণিরা রুদ্র-ধ্রুব-টুকিকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করব। কিন্তু আর কোনো টুকি যেন মা না হারায় বা আর কোনো রিফাত যেন অকালে, অবহেলায় হারিয়ে না যায়, সে ব্যাপারে রাষ্ট্র কবে দায়িত্ব পালন শুরু করবে?

লেখক: রিফাত সুলতানার সাবেক সহকর্মী