আরব দেশে মরুর খোঁজে

প্রথম আলোর উপসাগরীয় সংস্করণের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কাতারে যাওয়া। ভিনদেশে প্রথম আলোর অনুষ্ঠান। দিন তিনেক আগে গেলেও অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে ছিল ব্যস্ততা। কাজের খাতিরে রাজধানী দোহা আর আশপাশের কিছু এলাকা বাদে কাতারকে তেমন দেখা হয়ে ওঠেনি। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর হাতে পাওয়া গেল একটি দিন। আরব দেশে এসেছি, কিন্তু তখনো মরুভূমি দেখা হয়নি।
২৩ জানুয়ারি দোহায় হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে ভাবছিলাম, শহরে ঢোকার পথে সড়কের দুই পাশে হয়তো মরুভূমি দেখব। কিন্তু দোহায় আমাদের স্বাগত জানাল সবুজের ঢেউ। সড়কের দুপাশে সারি সারি গাছ। খেজুরের পাশাপাশি রয়েছে অন্য গাছও। মাঝেমধ্যেই দেখা মিলছে ভাঙাগড়ার খেলা। মরুভূমির চিহ্নও নেই কোথাও।
দেশে ফিরে যাওয়ার আগে একদিন সুযোগ পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম মরুভূমি দেখার। কাতারের সহকর্মীরা জানালেন, মরুভূমি দেখতে হলে দোহা থেকে বেশ দূরে যেতে হবে। তবে সন্ধ্যার মধ্যে দোহায় ফিরে আসা যাবে।
বেলা ১১টার দিকে বেরিয়ে পড়লাম মরুভূমির খোঁজে। যে সহকর্মীর গাড়িতে আমরা চড়লাম, তিনিই হলেন আমাদের ‘গাইড’। সালওয়া রোড ধরে কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর জনমানবশূন্য এলাকা। ঘরবাড়ি নেই। নেই কোনো কোলাহল।

পারস্য উপসাগরের বুকে ছোট একটি উপদ্বীপ কাতার। একমাত্র সৌদি আরবের সঙ্গে দেশটির ভূখণ্ডের যোগাযোগ রয়েছে। কাতারের মোট আয়তন ১১ হাজার ৫৮৬ বর্গকিলোমিটার বা ৪ হাজার ৪৭৩ বগর্মাইল। আমাদের রাঙামাটি জেলার দ্বিগুণের মতো হবে আয়তন। ছোট্ট দেশ হলেও মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে তাঁরা এক নম্বর ধনী দেশ। জনসংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ হলেও কাতারের নাগরিক মাত্র তিন লাখের একটু বেশি। বাকি সবাই অভিবাসী। তাই ছোট্ট দেশ হলেও রাজধানী দোহা ও গুটি কয়েক এলাকা ছাড়া বেশির ভাগ এলাকাই জনমানবশূন্য।
সালওয়া রোড ধরে আধা ঘণ্টার পথ চলার পর আবু নাখলা এলাকায় চোখে পড়ল কাতার অ্যাকুয়া পার্ক। কাতারের প্রথম এই থিম পার্কে সার্ফিং, ওয়েব পুল, লেজি রিভার, টিউব স্লাইডস, স্পিড লাইনসহ রয়েছে নানা রাইড। বেশ জনপ্রিয় এটি। সালওয়া রোড ধরে এগিয়ে সামনে গেলে মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে নির্মাণকাজের মহাযজ্ঞ। ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন হবে কাতারে। তাই সড়ক-মহাসড়ক, স্টেডিয়ামসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে জোরেসোরে। রাস্তার পাশে বেদুইনদের দু-একটা বাড়িও চোখে পড়ে। এর বাইরে সড়কের দুপাশে কেবলই বিস্তৃত মরু প্রান্তর। সোনালি বালুর জমিনে দূরে দূরে গাছগাছালি। মুকাইনিস, আলকিরানা হয়ে সালওয়া রোড চলে গেছে সীমান্তের দিকে। আমরা চলে এসেছি সৌদি আরব সীমান্তের কাছাকাছি। কিন্তু চোখে পড়ছে শুধু ধু ধু সোনালি বালুর প্রান্তর আর মাঝে মাঝে সবুজ গাছগাছালি।
নাহ্, মন ভরছে না। একজন টিপ্পনি কাটল, বাংলাদেশের পদ্মার চরে গেলেও এমন দৃশ্য দেখা যেতে পারে! হলুদ-বাদামি রঙের বালুর ঢেউ খেলানো প্রান্তর আর বালুর পাহাড় না দেখলে িক হয়? আমাদের সফরসঙ্গী প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বললেন, ‘এ তো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর অবস্থা। বালিয়াড়ি মানে ঢেউ খেলানো বালুর প্রান্তর দেখতে চাই।’ এবার আমাদের কাতারের আরেক সহকর্মী নড়েচড়ে বসলেন। তিনি বললেন, তাহলে যেতে হবে ওম সাইদে।
আবার গাড়ি ঘুরল। ছুটল ওম সাইদের পথে। প্রায় ৩৫-৪০ মিনিট গাড়ি চালানোর পর আমাদের চোখের সামনে আস্তে আস্তে ভেসে উঠতে লাগল মরুভূমির আসল রূপ। সহকর্মী জানালেন, ওম সাইদে এসে গেছি। কিন্তু সব জায়গায় লেখা িমসাইয়িদ। জানা গেল, জায়গাটির আসল নাম মিসাইয়িদ। তবে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মিসাইয়িদকে বানিয়েছেন ‘ওম সাইদ’। বাংলাদেশিদের কাছে এখন জায়গাটি এ নামেই পরিচিত।
বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সোনালি বালুরাশি। মাঝে মাঝে বালুর পাহাড়, দেখে মনে হচ্ছিল ধু ধু প্রান্তরে ঢেউ খেলছে বালু। বিস্তৃত বালুরাশির উল্টো দিকে পারস্য উপসাগরের নীলাভ জলরাশি। মরুভূমি আর সাগরের এমন মিলন দেখে মনে হচ্ছিল, শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো ছবি। বালুর পাহাড়ে বিক্ষিপ্ত অসংখ্য তাঁবু। এসব তাঁবুতে এখন আরবেরা থাকেন। সপরিবারে আরবেরা থাকায় সেদিকে যাওয়ার উপায় নেই।
আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লেও মরুভূমি এখনো আরবদের টানে। তাই সাপ্তাহিক ছুটির দুই দিন এখনো অসংখ্য আরব চলে যান মরুভূমির বুকে। হয়তো হাতড়ে বেড়ান নিজেদের ঐতিহ্য। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত তাঁবুতে পরিবার-পরিজন নিয়ে কাটিয়ে দেন দুই দিন। জিপ গাড়ি আর কোয়াড বাইক নিয়ে চলে ডেজার্ট সাফারি। চলে বালুর এক ‘দেয়াল’ থেকে আরেক ‘দেয়ালে’ ওঠানামার রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা।
আরবদের মতো আমরাও মরুভূমির প্রেমে পড়ে গেলাম। বিশেষ করে মরুভূমির ‘জাহাজ’ খ্যাত উট দেখার পর অন্য রকম রোমাঞ্চ হলো। আরবেরা পর্যটকদের জন্য মরুভূমির একমাত্র বাহন সেই উটে চড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। দেশি-বিদেশি প্রচুর পর্যটক উটের পিঠে চড়ে মরুভূমিতে চলার আসল স্বাদ নিচ্ছেন। আমরাও সেই স্বাদ নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করিনি।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। আমাদের দোহায় ফেরার তাগাদা। কী আর করা! মরুভূমি দেখার আংশিক স্বাদের স্মৃতি নিয়েই আমাদের ফিরতে হচ্ছে। দোহায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। আলোঝলমলে আর চোখ ধাঁধানো গগনচুম্বী ভবনের দোহা নগরীতে ঢুকে বোঝার উপায় নেই, মাত্র ৪০-৪২ কিলোমিটার দূরে রয়েছে কাতারের মরুময় আরেক অপরূপ সৌন্দর্য।